1773866670

এক নজরে

সমুদ্রের নীচে আগ্নেয়গিরি ও অগ্নুৎপাত

By admin

March 15, 2025

আগ্নেয়গিরি বা অগ্নুৎপাতের কথা কম বেশি সবারই জানা। সাধারণত আগ্নেয়গিরি থাকে পাহাড় কিংবা পাহাড় চূড়ায়। কিন্ত সমুদ্রের নীচে আগ্নেয়গিরির কথা সাধারণভাবে আমাদের মধ্যে অনেকেরই অজানা। কয়েক বছর আগে হুঙ্গা-টোঙ্গা-হুঙ্গা-হা’পায় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র টোঙ্গাতে সুনামি আঘাত হেনেছিল। সেই আগ্নেয়গিরিটির অবস্থান কিন্তু সমুদ্রের নীচে ছিল। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, সুনামিটি অগ্ন্যুৎপাত থেকে বিস্ফোরণের কারণে ঘটেছিল নাকি, আগ্নেয়গিরির কোনো ধসে জলের স্থানচ্যুতি হওয়াতে অথবা দুটোর কারণেই ঘটেছিল, তা বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করেন নি। তবে ওই দুর্ঘটনাটির কথা শুনে সাধারণ মানুষদের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, কারণ জলের নীচেও যে আগ্নেয়গিরি থাকতে পারে বেশির ভাগ মানুষের কাছেই তা অজানা। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে সমুদ্রের নীচে আগ্নেয়গিরির সংখ্যা একশো থেকে এক হাজারের মধ্যে। এই সব আগ্নেয়গিরি শুধু আগুনের লাভাই ছড়ায় না, অনেক ছাইও তৈরি করে। পৃথিবীতে আগ্নেয়গিরি সংক্রান্ত ঘটনাগুলির চার ভাগের তিন ভাগই ঘটে সমুদ্রের নীচে। আর নিচের এই আগ্নেয়গিরির কারণেই সমুদ্রের তলদেশে তৈরি হয় পাহাড়।

কয়েক বছর আগে দ্য আর্কটিক ইউনিভার্সিটি অব নরওয়ের (ইউআইটি) বিজ্ঞানীরা নরওয়ের উপকূলে বেরেন্টস সাগরের নীচে এক আগ্নেয়গিরির খোঁজ পেয়েছিলেন।বিশেষ জলযান আরওভি অরোরার সাহায্যে একটি অনুসন্ধানকারী জাহাজ ক্রনপ্রিন্স হাকন এর হদিশ পায়‌। সমুদ্রের তলায় বিরাট এই আগ্নেয়গিরির জন্ম নাকি ১৮০০০ বছর আগে। বিয়ার দ্বীপ থেকে ৭০ নটিক্যাল মাইল, এক নটিক্যাল মাইল মানে ১.৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং জলের ৪০০ মিটার গভীরে অবস্থিত এই আগ্নেয়গিরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়, নরওয়ের জলসীমার মধ্যে আবিষ্কৃত দ্বিতীয় কাদা উদগীরণকারী আগ্নেয়গিরি এটি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে মাড ভলক্যানো বলা হয়।

সমুদ্রের তলায় মিথেন গ্যাস কীভাবে কাজ করে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেই বিজ্ঞানীরা শুরু করেছিলেন গবেষণা। এই মিথেন একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। দিন দিন পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার জন্য মিথেন অনেকটা দায়ী।‌ তার খোঁজে বেরিয়েই খোঁজ মেলে সমুদ্রের নীচে এই আগ্নেয়গিরির‌। মিথেন অনুসন্ধান প্রকল্পের প্রধান তদন্তকারী ও অধ্যাপক গিউলিয়ানা পানেরি জানান, ‘জলের নীচে এমন কাদার বিস্ফোরণ দেখলে বোঝা যায়, এই গ্রহের নীচটা এখনও জীবন্ত!’ আবিষ্কৃত ওই আগ্নেয়গিরির নাম দেওয়া হয় ‘দ্য বোরিয়ালিস মাড’। সব মিলিয়ে ৩০০ মিটার চওড়া এবং ২৫ মিটার গভীর একটি গর্তের ভিতরে রয়েছে এই আগ্নেয়গিরি। তবে এমন এক গর্তের ভিতরে কেন আগ্নেয়গিরি? তার সম্ভাব্য কারণও জানিয়েছেন গবেষকরা। গবেষকদের মতে, সম্ভবত কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলেই এমন গর্ত তৈরি হয়। প্রায় ১৮,০০০ বছর আগে গ্লেসিয়ার পর্ব শেষ হওয়ার ঠিক পরেই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছিল। গবেষকেরা এও জানান, বেরেন্টস সাগরের নীচে এমন আরও আগ্নেয়গিরি রয়েছে বলেই তারা সন্দেহ করছেন। তাঁদের কথায়, দলগত প্রচেষ্টার ফলে এই আগ্নেয়গিরির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এই ধরনের আগ্নেয়গিরি থেকে প্রাচীন পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়। ফলে আগামী দিনের এই আগ্নেয়গিরি নিয়ে গবেষণা হলে আরও নতুন তথ্য পাওয়া যাবে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের।

বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের গ্রহের বেশিরভাগ আগ্নেয়গিরি আসলে জলের নীচের আগ্নেয়গিরি, এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। এগুলো খুব নীরবে অর্থাৎ বিস্ফোরকভাবে নয়; অগ্ন্যুৎপাত করে তাই কেউ টের পায় না, কিভাবে জলের নীচে আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়? সাবমেরিন বা জলের নীচে এবং সাবএরিয়াল অর্থাৎ স্থলে আগ্নেয়গিরির গঠনের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট পার্থক্য নেই। বিজনানীরা বলেন, পৃথিবীর অভ্যন্তরের দ্বিতীয় স্তরে বেশিরভাগই শক্ত আবরণে গলিত শিলা উৎপন্ন হলে এবং ভূত্বকের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করলে আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়। বেশিরভাগ সাবমেরিন আগ্নেয়গিরি মধ্য-সমুদ্রের শৈলশিরা বরাবর ক্রমাগত সক্রিয় আগ্নেয়গিরির সঙ্গে সম্পর্কিত, যেখানে দুটি টেকটোনিক প্লেট আলাদা হয়ে যাচ্ছে। দুটি প্লেটের সংঘর্ষের ফলেও আগ্নেয়গিরি হতে পারে। যদি দুটি টেকটোনিক প্লেট সমুদ্রের নীচে থাকে, তাহলে আগ্নেয়গিরিটি জলের নীচে বিকশিত হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আগ্নেয়গিরির দ্বীপে পরিণত হতে পারে। একটি একক টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপের ফলেও আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হতে পারে। এটি তখন ঘটতে পারে যখন একটি মহাসাগরীয় প্লেটের নীচে একটি হটস্পট থাকে, যা হাওয়াইয়ের মতো আগ্নেয়গিরির দ্বীপগুলির একটি শৃঙ্খল তৈরি করে।

জলের নীচের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাব নির্ভর করে জলের পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থানের উপর। যদি অগ্ন্যুৎপাতটি জলের খুব গভীরে ঘটে, তাহলে উপরের জলের ওজন চাপের স্তর হিসেবে কাজ করে। যদি গলিত পাথরের একটি টুকরো ভূপৃষ্ঠ থেকে দু’কিলোমিটার (১.২৪ মাইল) নীচে সমুদ্রে প্রবেশ করে, তাহলে সেটি ঠান্ডা সমুদ্রের জলের সংস্পর্শে আসবে এবং খুব দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাবে। জল খুব গরম হয়ে যাবে, কিন্তু বাষ্পে পরিণত হবে না। কিন্তু যদি জল যথেষ্ট অগভীর হয়, তাহলে ম্যাগমা জলকে উত্তপ্ত করতে শুরু করে, যা পরে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে আয়তনে বড় পরিবর্তন আসে। বাষ্প বিস্ফোরণ সত্যিই ধ্বংসাত্মক কারণ, অল্প পরিমাণে জল বিশাল পরিমাণে বাষ্পে পরিণত হয়। সুনামি ছাড়াও, অগভীর জলে জলের নীচের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় বাতাসে যে ছাই নির্গত হয় তা মানুষের শরীরের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ছাই এবং নির্গত গ্যাসগুলি কেবল বায়ু দূষিত করে না বরং বিদ্যুৎ এবং জল সরবরাহের অ্যাক্সেসকে প্রভাবিত করতে পারে।