একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হল কথা বলা। বাকপ্রতিবন্ধী ছাড়া এমন কোনো মানুষ নেই যে, কথা না বলে দিন কাটাতে পারেন। যদি কারও সঙ্গে ঝগড়া কিংবা মনোমালিন্যও হয় সেক্ষেত্রেও বড়জোর ২-৩ দিনের বেশি কথা না বলে কেউ থাকেন না। কিন্তু দিনের পর দিন একেবারেই মুখে তালা মেরে রাখা কি সম্ভব? অবিশ্বাস্য এবং অদ্ভুত শোনালেও এমন অদ্ভুত গ্রাম আছে যেখানকার বাসিন্দারা টানা ৪২ দিন কথা বলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। ইশারার মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে এই সময় তারা যোগাযোগ রাখেন। এর পেছনের রহস্য কী? আসলে তারা এই সময় দেবতাকে তুষ্ট করতে মৌনব্রত পালন করেন। তাই টানা ৪২ দিন কেউ কারও সঙ্গে কোনো ধরনের কথা বলেন না। হিমাচল প্রদেশের মানালির কুলু জেলার গোশাল গ্রামের মানুষ জানুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ থেকে ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ পর্যন্ত কোনো কথা বলেন না। এমনকি কোনো এই সময় ওই গ্রামে আসা পর্যটককেও কথা বলার সুযোগ দেন না গ্রামের বাসিন্দারা। কথা না বললেও তারা এই সময়ে হেডফোনে গান শোনেন, বেড়াতে যান এবং চুপচাপ বাড়ির কাজ করেন।
গোশাল গ্রামটি বেশিরভাগ সময়ই বরফে আচ্ছাদিত হয়ে থাকে। এই গ্রামে প্রচলিত রয়েছে অনেক পৌরাণিক গল্প, যা গ্রামবাসীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। আর সেই বিশ্বাস থেকেই তারা এমনটি করেন বলে জানা গেছে। জানা গিয়েছে, ৪২ দিন কথা না বলার প্রথাটি এসেছে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। এই বিশ্বাস কেবল গোশালেই নয়, পাশের বুরুয়া, শানাগ ও কুলাং গ্রামবাসীরও। এছাড়া হিমাচল প্রদেশের মাঝাচ, পালচান, কোঠি, রুয়ার গ্রামের বাসিন্দারাও ৪২ দিন নীরবতা পালনের বিষয়টি বিশ্বাস করেন। তাই বলে টানা ৪২ দিন কেন চুপ করে থাকেন এই গ্রামগুলোর বাসিন্দারা? ধর্মীয় মতে, জানুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ থেকে ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ- এই সময় গভীর ধ্যান শেষ করে ঈশ্বর স্বর্গের পথে ফিরে যান। আর ঈশ্বরের স্বর্গে যাওয়ার পথে যাতে কোনো অসুবিধার মুখে না পড়েন, তাই এই সময় কথা বলা বন্ধ রাখেন গ্রামবাসীরা।
এ বিষয়ে যে পৌরাণিক কাহিনী জুড়ে আছে- স্থানীয় বিপাশা নদীর তীরে বসে ঋষি গৌতম তপস্যা করছিলেন। গ্রামবাসীরা মনে করেন ঋষি গৌতম এখনও ধ্যানে মগ্ন। সেই তপস্যাকে শ্রদ্ধা জনাতে যেন হইচই বা আওয়াজ না ছড়ায় তাই চুপ করে থাকেন গ্রামবাসী। সোলাং ও রুয়ার গ্রামের বাসিন্দারা শুধু চুপ করেই থাকেন না, পাশাপাশি নিয়মিত কৃষিকাজ বন্ধ রাখেন। গোশাল গ্রামে রয়েছে বহু প্রাচীন একটি মন্দির, যেখানে গৌতম ঋষি, বেদব্যাস ও কাঞ্চন নাগের পূজা অর্চণা করা হয়। সারা বছরজুড়ে এই মন্দির দেখতে আসেন পর্যটকরা। তবে এই ৪২ দিন মন্দিরেও উপাসনা বন্ধ হয়ে যায়। মন্দিরে কোনোরকম পুজোও করা হয় না। জানা গিয়েছে, মন্দির খোলার পর যদি মেঝেতে একটা ফুল পড়ে থাকতে দেখা যায়, তবে সেটা গ্রামগুলির জন্য শুভ বলে মনে করা হয়। আর যদি ফুলের বদলে কয়লার টুকরো পড়ে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, পাঁচ দিনের মধ্যেই গ্রামে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
গোশাল গ্রামের এমন রীতি নিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরফ ঢাকা এই জায়গাগুলিতে এই সময়ে সূর্যের দেখা মেলে না। সেই সময় সেখানে এতটাই বেশি বরফ পড়ে যে, দৈনন্দিন কর্মক্ষমতাই থাকে না স্থানীয় বাসিন্দাদের। কৃষিকাজ বাধাগ্রস্ত হয় বৈরী আবহাওয়ায়। এই সময় শীতে কাবু হয়ে তারা অলস সময় কাটান। তাই কথা বলা বা বাড়ি থেকে বেরোনোর সুযোগ মেলে না তাদের। মাঘ মাসে মকর সংক্রান্তির সময় থেকে এই রীতি চালু হয়।