এক নজরে

ছাপাখানার ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর

By admin

September 26, 2022

এবার ধার করা টাকা শোধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বিদ্যাসাগর। ভেবেচিন্তে হাজির হলেন ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের মার্শাল সাহেবের কাছে। তাঁকে গিয়ে বললেন, একটা ছাপাখানা খুলেছি, আপনার যদি কিছু ছাপানোর দরকার হয়, আমাদের বলবেন। মার্শাল সাহেব বিদ্যাসাগরকে ছাপার কাজ দিয়েছিলেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল তখন ছাপাই ছিল কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পড়ুয়াদের অন্নদামঙ্গল যে বইটি পড়ানো হত তার কাগজের মান যেমন খারাপ, তেমনি খারাপ ছাপা ও বাঁধাই। এছাড়া ভুলভ্রান্তিও ছিল প্রচুর। এরপর মার্শাল সাহেব কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে আদি অন্নদামঙ্গলের পুথি আনিয়ে বিদ্যাসাগরকে দিলেন। বিদ্যাসাগর আর মদনমোহন সেটি ছাপলেন।

তাঁরা অন্নদামঙ্গলের প্রতি কপির দাম রাখলেন ছ’টাকা। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ একশো বই কিনে ছ’শো টাকা বিদ্যাসাগরের হাতে তুলে দিলেন মার্শাল সাহেব। নীলমাধবের ধার শোধ হয়ে গেল। অন্নদামঙ্গলের বাকি কপি বিক্রির টাকা রাখা হল প্রেসের উন্নতির জন্য। এরপর সাহিত্য, ন্যায়, দর্শনের নানা বই ছাপলেন বিদ্যাসাগর। আর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ সেই বই কিনতে লাগলো। জন্য ছাপতে লাগলেন বিদ্যাসাগর।‘সংস্কৃত যন্ত্র’ ফুলে ফেঁপে উঠলো।

সংস্কৃত প্রেস থেকে সিলেবাসের বইই বেশি ছাপতেন বিদ্যাসাগর। সেই সব বইয়ের বেশিটাই বিক্রি হত কলেজ স্ট্রিটে থেকে। কিন্তু কলেজ স্ট্রিট তখন মোটেই  বইপাড়া নয়, তখন সেখানে কোনও বইয়ের দোকানও ছিল না। ধীরে ধীরে সেই সংস্কৃত যন্ত্র বা প্রেসের যেহেতু প্রকাশনার কাজও ছিল, তাই মুদ্রণ যন্ত্র বা মেশিন ঘরের পাশের ঘরে একটি বই রাখার বা ডিপজিটরি খোলার পর ছাপাখানা ও প্রকাশনা সংস্থার নামকরণ হয় সংস্কৃত প্রেস এন্ড ডিপজিটরি। পরবর্তী কালে ছাপাখানা ও প্রকাশনা সংস্থাটি বিপণি কেন্দ্রও হয়ে উঠেছিল। কারণ সংস্কৃত যন্ত্র ছাড়াও অন্য সংস্থা থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত বইও, বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক, এই ডিপজিটরিতে রাখা হত। হিসেব অনুযায়ী, ১৮৫৫ সাল নাগাদ সংস্কৃত যন্ত্র-এর বইয়ের ব্যাবসা থেকে মাসে অন্তত হাজার তিনেক টাকা আয় হত বিদ্যাসাগরের। ১৮৫৭-৫৮ সালে কলকতার ছেচল্লিশটি প্রেস থেকে যে ৫৭১৬৭০ কপি বাংলা বই ছেপে বেরিয়েছিল তার মধ্যে সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা বই ছিল ৮৪২২০টি। ওই সময় একটি বছরে বিদ্যাসাগরের বইয়ের ২৭টি সংস্করণ বেরিয়েছিল। 

তবে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেও বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ ও নানা রকম সমাজ সংস্কারের কাজে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতেন। পাশাপাশি বই লেখা, মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের দায়িত্ব সামলাতে হত। কাজেই প্রেস ও ডিপোজিটরির কাজ নিজে দেখার সময় পেতেন খুব কম। সেই সুযোগ যে কর্মচারীরা পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করবে সে কথা বলাই বাহুল্য। ফলে বিশৃঙ্খলা ধীরে ধীরে চরম আকার ধারণ করে। এদিকে বিধবাবিবাহ দিতে গিয়ে তিনি ঋণের ভারে জর্জরিত। তখন পর্যন্ত ষাট জন বিধবার বিয়ে দিতে খরচ করেছেন প্রায় বিরাশি হাজার টাকা। ঋণের আর একটি কারণ হল, ১৮৬৬-৬৭ সালের দুর্ভিক্ষে বীরসিংহ ও বর্ধমানে বিদ্যাসাগর নিজের খরচে অন্নসত্র খুলেছিলেন। তাই ১৮৬৯ সালে মাত্র আট হাজার টাকায় প্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন। আর বুক ডিপোজিটরি দশ হাজার টাকার বিনিময়ে দান করে দিলেন কৃষ্ণনগরের ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায়কে। আরও অনেক বেশি টাকায়  সেই ডিপোজিটরি কিনে নেওয়ার লোক তখনও অনেক ছিল। তা করলে বিদ্যাসাগরের বিপুল ঋণের বোঝা বেশ কিছুটা লাঘব হতে পারত। কিন্তু তা তিনি করলেন না। তখন তাঁর মন যে অত্যন্ত বিষন্ন।