কলকাতা ব্যুরো: সঙ্গীত জগতে নক্ষত্রপতন। চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বিগত কয়েক দিন ধরেই বেজায় অসুস্থ ছিলেন নবতিপর কিংবদন্তী শিল্পী। গীতশ্রীর প্রয়াণে দেশের শিল্পীমহলে শোকের ছায়া। মঙ্গলবার ট্যুইট করে একথা জানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তাঁর মৃত্যুতে অবসান হল সঙ্গীতময় এক যুগের ৷ এদিকে দুঃসংবাদ পেয়েই উত্তরবঙ্গের কর্মসূচি কাটছাঁট করে বুধবারই কলকাতায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে পিস ওয়ার্ল্ডে রাখা থাকবে তাঁর মরদেহ। বুধবার বেলা ১২টা থেকে রবীন্দ্র সদনে রাখা থাকবে দেহ। সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন সাধারণ মানুষ। মুখ্যমন্ত্রী কলকাতায় ফেরার পর আগামিকালই পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে গীতশ্রীর।

গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, আমি মনে করি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ভারতরত্ন। একটা শতাব্দীর আর কেউ রইলেন না। আমি ভাবতেই পারছি না। পাশাপাশি মমতা জানালেন, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে গীতশ্রীর। মমতা এদিন আরও বলেন, ছেলেমানুষের মতো ছিলেন সন্ধ্যাদি। আমায় যখনই ফোন করতেন, বলতেন একটা গান শোনাও মমতা। আমি বলতাম দিদি আপনি গানের দিশারী। আমি আপানার সামনে কখনও গান গাইতে পারি? তিনি তাও নাছোড়বান্দা। বলতেও গান শোনাতেই হবে। আমায় তাই ফোনেই গান শোনাতে হত ওঁকে।”
প্রতিবছর মুখ্যমন্ত্রীর জন্মদিনে নিয়ম করে ফোন করতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই কথাও স্মরণ করেন মমতা। তিনি বলেন, ”আমায় খুব ভালোবাসতেন উনি। সংগীতজগতের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। বাংলা সংস্কৃতির বড্ড ক্ষতি হয়ে গেল। উনি অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই সকলে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমি নিয়মিত খবর নিতাম। মাঝখানে তাঁর শারীরিক অবস্থা ভালো হয়েছিল। কিন্তু, কাল রাতে আমার কাছে খবর এসেছিল যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল। এদিনে যে হঠাৎ কী হয়ে গেল…। এত তাড়াতাড়ি যে এই ঘটনাটি ঘটে যাবে ভাবিনি। এত খারাপ লাগছে, তিনি এত ভালোভাবে জীবন কাটিয়েছেন। নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলতেন।
সেই স্বর্ণ সংগীতের যুগ পেরিয়ে এসেছি আমরা। সন্ধ্যাই আমাদের শেষ সুরের ঝংকার, সুরের স্পন্দন ছিলেন। কত ভালো ভালো গান ছিল তাঁর। সমস্ত ভালো ভালো গান মনে পড়ছে আজকে।” তিনি জানান, বুধবার শেষকৃত্য হবে ‘গীতশ্রী’ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের।
জানুয়ারির শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। প্রথমে এসএসকেএম হাসপাতলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ জানুয়ারি রাতে আচমকাই জ্বর আসে শিল্পীর। সকালে জ্বর বাড়লে চিকিৎসকদের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেখানে পরীক্ষা করালে করোনা ধরা পড়ে গীতশ্রীর। খবর পেয়ে ২৭ জানুয়ারিই এসএসকেএম হাসপাতালে ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে শিল্পীর শারীরিক অবস্থা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। এরপর সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে এসএসকেএম থেকে শিল্পীকে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন। শিল্পীর বাড়ির লোকজন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চাইলেও, শিল্পীর যেহেতু হৃদযন্ত্রের সমস্যা রয়েছে, তাই কোনওরকম ঝুঁকি নিতে চাননি মমতা।

১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রেলে চাকরি করতেন। আর ঠাকুরদা ছিলেন জাদরেল পুলিশ অফিসার। ছ বোনের কনিষ্ঠতম সন্ধ্যার শৈশব থেকেই গানের প্রতি আলাদা টান ছিল। পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে গানে হাতেখড়ি করেছেন। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, এমনকী তাঁর পুত্র উস্তাদ মুনাবর আলি খানের কাছেও শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

১৯৪৮ সালে প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের পাশাপাশি ফিল্মি দুনিয়াতেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই পথ যদি না শেষ হয়, এ শুধু গানের দিন, এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে, চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে, আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি.. তাঁর কণ্ঠে এহেন অজস্র গান শ্রোতাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
একসময়ে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও চুটিয়ে গান গেয়েছেন তিনি। ১৭টি হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করেছেন। পাশাপাশি নিজস্ব অ্যালবামও বের করেছেন। পঞ্চাশের দশকে মুম্বইতে সন্ধ্য়া মুখোপাধ্যায়ের কেরিয়ার যখন মধ্যগগনে তখন বিয়ের জন্য কলকাতায় ফিরে আসেন। মনস্থ করেন এখানে থেকেই সংসার গুছিয়ে পাশাপাশি গানের কেরিয়ার চালিয়ে যাবেন। শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, অনিল বিশ্বাস, মদন মোহন, রোশন প্রমুখের মতো খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

একুশের অক্টোবর মাসেই নবতিপর হয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। স্বর্ণযুগের এই কিংবদন্তী গায়িকা ভূষিত হয়েছেন গীতশ্রী সম্মানেও। পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ। এমনকী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের হাতে উঠেছিল জাতীয় সম্মানও। কালের নিয়মে তিনিও শিরোনাম থেকে হারিয়েই গিয়েছিলেন। জন্মদিন ছাড়া তাঁকে নিয়ে কলমের আঁচড় সাধারণত আর পড়ত না। তবে সাধারণতন্ত্র দিবসের আগের বিকেলে পদ্ম সম্মান-এর ঘোষণাই ফের আলোড়ন ফেলে দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পদ্ম-প্রস্তাব পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে দিলেন বাঙালি কিংবদন্তী গায়িকা। দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার দেশ আমাকে যেভাবে ভালবাসে, সেখানে আমার পদ্মশ্রী কিংবা কোনও শ্রীর-ই প্রয়োজন নেই।