যে মানুষটি হয়েছিলেন ‘হীরক রাজার দেশে’র রাজা, তিনিই আবার হন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া। এমন বহু বিখ্যাত চরিত্রের অভিনেতা তিনি। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মেঘরাজ, ‘আগন্তুক’-এর মনোমোহন মিত্র, ‘অমানুষ’-এর মহিম ঘোষাল, ‘জন অরণ্য’-এর বিশুদা—এমন আরও অনেক চরিত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন উৎপল দত্ত।‘টিনের তলোয়ার’ হাতে তুলে নিয়ে ‘অঙ্গার’ উত্তাপ ছড়ানো উৎপল নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যেকোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি, আমি প্রোপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।’

শিলংয়ের এডমন্ড স্কুল থেকে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, তারপরসেন্ট জেভিয়ার্স। ১৮ বছরের তরুণ উৎপল দত্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস নাট্যদল গঠন করেন। এমনিতে ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, থিয়েটার, চলচ্চিত্র ও ধ্রুপদি সংগীত তাঁর মাথায় ঢুকেছিল ওই সময়ে। হেগেল, মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিনে ঋদ্ধ হয়েছেন উৎপল। কলেজের গ্রন্থাগারটি তাঁর প্রিয় জায়গা ছিল। ওই সময় উৎপল নামের পিদিমের সলতেটায় আগুন ধরিয়েছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ পরিচালক ও অভিনয়শিল্পী জেফ্রি কেন্ডাল। ১৯৪৭ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে একটি শেক্সপিয়ার প্রযোজনা দেখে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কেন্ডালের শিক্ষা আর প্রশিক্ষণে উৎপল হন বরেণ্য শিল্পী।

শেক্সপিয়ারের নাটক এবং তা ইংরেজিতেই মঞ্চস্থ করে উৎপল দত্তের নাট্যজীবন শুরু। ১৯৪৯ সালে এই দলের নাম বদলে হয় কিউব। ইউরোপ ও আমেরিকার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার দলের নাম বদলে করেন লিটল থিয়েটার গ্রুপ। ১৯৫২ সালে এই দলে যোগ দেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা। ১৯৫১ সালে উৎপল ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘ভারত রক্ষা’ আইনে গ্রেপ্তার হন উৎপল দত্ত। সাত মাস জেলে কাটে। কিন্তু কারাগারের দিনগুলোতেও দিন বদলের স্বপ্ন তাঁকে ছেড়ে যায়নি। গিরিশচন্দ্রের পর বাংলা নাট্য ইতিহাসে উৎপল দত্তের মধ্যেই দেখা যায় নট, নাট্য পরিচালক ও নাট্যকার প্রতিভার অতুলনীয় সমন্বয়।ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বাংলা নাটককে যেভাবে সমাজ পরিবর্তনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে যার পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাকেই আরও অগ্রসর ও শিল্পসম্মত রূপ দান করেছিলেন উৎপল দত্ত। হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ, পালঙ্ক, পদ্মা নদীর মাঝি, আগন্তুক, জন অরণ্য,ভুবন সোম থেকে সাহেব, দত্তা, গোলমাল, অমানুষ, আনন্দ আশ্রম, সৌকিন বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের সমস্ত শ্রেণীতে তাঁর অবাধ বিচরণ।

ডায়ালগ মনে রাখার অসম্ভব স্মরণশক্তি ছিল তাঁর। সহ শিল্লীদের প্রায়শই অসুবিধায় পরতে হত কারণ তিনি ঝরঝর করে বিশাল স্ক্রিপ্ট মুখস্থ বলে যেতে পারতেন। হীরক রাজার দেশেতে বৈজ্ঞানিককে নিয়ে বলা একটানা বিশাল একটি ডায়ালগ, তাও আবার নানারকম আঙ্গিকে অভিনয় করে, আমরা দেখতে পাই যেটা আনকাট শ্যুটিং করা। হয়ত সুদক্ষ মঞ্চাভিনেতা ছিলেন বলেই এটা সম্ভব হত।

অসম্ভব প্রতিভাধর এই মানুষটি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁর অনেক বক্তব্য আজ খুব প্রাসঙ্গিক। আগন্তুকের সময়ে সত্যজিৎ রায় তাকে বলেন, আমি যেটা বলতে চাই সেটা তোমার মুখ দিয়ে বলাচ্ছি। আমার মনে হয় মণিমোহনের বক্তব্যগুলো উৎপলবাবু নিজেও বিশ্বাস করতেন। বেশ অসুস্থ শরীরেই শ্যুটিং শেষ করেন উৎপলবাবু আর চরিত্রটিকে অমর করে যান। একের পর এক সফল হিন্দি ছবিতে অভিনয় করে সারাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয় তবুও নিজের শেকড়কে ভোলেননি কখনো। কলকাতা, বাংলা, বাঙালির সাথে যোগ ছিল অবিচ্ছেদ্য।

সম্ভবত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কারণেই তাঁর ঝুলিতে মাত্র ১টি জাতীয় পুরস্কার। হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। সত্যজিৎ রায় মনে করতেন, যদি উৎপল দত্ত, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্তর মতো প্রতিভা বিদেশে জন্মাতেন, তা হলে তাঁরা অস্কার পেতেন। একেবারেই অতিশয়োক্তি নয়। পুরস্কারের গণ্ডিতে তাঁর মতো অভিনেতাকে বাঁধতে চাওয়া মুর্খামির নামান্তর। ব্রেখট-এর ভক্ত উৎপল অগাধ পাণ্ডিত্য নিয়ে নিজের বিবেকের কাছে সব সময় জবাবদিহি করে গিয়েছেন, সোচ্চারে বলেছেন তিনি সমাজতান্ত্রিক বামপন্থী।