প্রায়শই বাজারে পেঁয়াজের দামের ঝাঁজে মধ্যবিত্তের চোখ জলে ভরে যায়। অথচ গোটা বিশ্বে কয়েকশো জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন হয়।  বহুকাল ধরেই রান্নার অতিজনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় উপাদানের মধ্যে একটি হলো পেঁয়াজ। ইতিহাসবিদদের মতে, মানবসভ্যতায় গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। নানা জলবায়ুতে খাপ খাইয়ে নেওয়া, বহুদিন সংরক্ষণ করা যায় এবং সহজে বহন করা যায় বলে প্রাচীনকাল থেকে মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল অতিপ্রয়োজনীয় একটি খাদ্য উপাদান।  প্রাচীনকালে পেঁয়াজের কদর আজকের থেকেও বেশি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫১ শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যে অধিবাসীরা কর ও ভাড়া পরিশোধ করতেন পেঁয়াজ দিয়ে।  

কেবল প্রাচীনকালে নয়, পেঁয়াজও এখন বিনিময়ের বাহক বা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হলেও ইদানীং বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে ফিলিপাইনে। সেখানে পেঁয়াজ এখন বিলাসী পণ্য। কারণ দেশটিতে এটির মূল্য বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে। ম্যানিলার একটি বড় দোকানে অনেক ফিলিপিনোকে দেখা যায়, পকেটে করে পেঁয়াজ নিয়ে আসতে। এই পণ্যের বিনিময়ে তারা অন্যান্য পণ্য কিনতে পারছেন। ম্যানিলার উত্তরের কুইজোন শহরে জাপান হোম সেন্টারের ভেতরে দেখা গেছে, যেসব পণ্যের দাম ৮৮ পেসো বা তার নিচে সেগুলো একটি পেঁয়াজের বিনিময় পাওয়া যাচ্ছে। জানা গেছে, ফিলিপাইনের এই নতুন মুদ্রা দিয়ে সর্বোচ্চ তিনটি আইটেম কেনা যায়। তাই নতুন মুদ্রা পেঁয়াজ নিয়ে দোকানে ভিড় জমাচ্ছে ক্রেতারা। এমন পরিস্থিতিতে যারা পেঁয়াজ দিয়ে অন্য পণ্য কিনতে চায় তাদের জন্য বিক্রেতারা বিশেষ লাইনের ব্যবস্থা করছে। মূলত ফিলিপাইনে বাজারে, রেস্তোরাঁয় কিংবা বাড়িতে কোথাও পেঁয়াজ নেই। দেশটির পরিসংখ্যান বলছে, ফিলিপাইনে গত ডিসেম্বরে পেঁয়াজ বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ৭০০ পেসো বা ১২ দশমিক ৮০ ডলার বা ১ হাজার ৩৫৮ টাকা দরে। দেশটিতে পেঁয়াজের এই দাম মাংসের দামের চেয়েও বেশি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দৈনিক ন্যূনতম মজুরির সমান। দেশটিতে এখনো একই রকম পরিস্থিতি।

পেঁয়াজ প্রাচীন মসলা। সেই প্রাচীন রোমের এক বিখ্যাত খাদ্যরসিক এপিসিয়াসের লেখাতে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত পিরামিডের নির্মাণকাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের রান্নার মেনুতেও ছিল পেঁয়াজ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীতে যখন কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি সেই সময়েও খাদ্য হিসেবে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ঠিক কবে থেকে এই পেঁয়াজের চাষাবাদ শুরু হয়েছিল কিংবা ঠিক কবে থেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রচলন ঘটে তা সঠিক জানা যায়নি। মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিল প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাতো পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত সেসময় খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতো।

ষোড়শ শতাব্দীতে মানুষ আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিল উন্নত জীবন ও জীবিকার আশায়। উত্তর আমেরিকায় উপনিবেশ গড়া ইউরোপীয়দের প্রথম চাষ করা ফসল ছিল পেঁয়াজ। তবে ইউরোপীয়দের আগমনের আগেই সেখানকার আদিবাসীদের মধ্যে পেঁয়াজের ব্যবহার ছিল। রান্নার পাশাপাশি তারা নানা সিরাপ, রঙ ও ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য পেঁয়াজ ব্যবহার করত। পেঁয়াজের জনপ্রিয়তার কারণেই বিশ্বজুড়ে এটি বাণিজ্য পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয়। ইউরোপজুড়ে যে সবজিগুলোর চাহিদা বাড়ছিল তার মধ্যে এটি ছিল একটি। এর অন্যতম কারণ ছিল এটি দ্রুত পচনশীল নয়, যদি শুকনো ও সূর্যালোক থেকে দূরে রাখা হয় পেঁয়াজ ছয় মাস পর্যন্ত ভালো থাকে, তাই সংরক্ষণ করা সহজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তুষার হিম ঠাণ্ডায়ও এটি সহনশীল। এককথায় যেকোনো আবহাওয়ায়ই পেঁয়াজ ফলানো যায়। পাশাপাশি পেঁয়াজ উচ্চফলনশীল ও চাষে বেশি শ্রম দিতে হয় না।

ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পেঁয়াজের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ্যার গ্রন্থ চক্র সংহিতাতেও ওষুধ হিসাবে পেঁয়াজের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে পেঁয়াজকে মূত্রবর্ধক, হজমে সহায়ক, হৃদপিন্ড ও চোখের জন্য উপকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর প্রাচীনকালের এসব বর্ণনার সত্যতা মিলছে বর্তমানের আধুনিক নানা গবেষণায়। বর্তমানে পেঁয়াজের নানা ওষধি গুণ কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। পেঁয়াজ থেকে নানা ওষুধও তৈরি হয় এখন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version