গানের পরিবারেই তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বাড়িতে তাঁর বাবা অনেক ছাত্র-ছাত্রীকেই সঙ্গীত শিক্ষা দিতেন। অথচ তাঁর মেয়ে ছোটবেলা থেকে গান শিখলেও সঙ্গীতে তেমন কোনও ছাপ রাখতে পারেন নি। তবে সেই মেয়েই একদিনের ঘটনায় তাঁর বাবাকে ব্বশ চমকে দিলেন। কোনও একটি কাজে তাঁর বাবাকে কিছু সময়ের জন্য বাইরে যেতে হল। এক ছাত্রকে তিনি ডেকে বললেন,‘গান চালিয়ে যাও, আমি একটু পরেই ফিরছি’।ফিরে এসে তিনি ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর মেয়ে অন্য ছাত্রছত্রীদের গাওয়া রাগ শুধরে দিচ্ছে।

যখন মেয়েটির বয়স পাঁচ বছর তখন থেকেই সে তাঁর বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকের ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করতেন। একদিনতাঁর বাবার নাটকের অভনয় রয়েছে। কিন্তু সেই নাটকের নারদ মুনির চরিত্রের অভিনেতার পাত্তা নেই। নাটকে সেই অভিনেতা গানও করেন। মেয়েটি লক্ষ্য করলতাঁর বাবা চিন্তায় খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন। তখন মেয়েটি তাঁর বাবাকে এসে বলল, আমি নারদের ভূমিকায় অভিনয় ও গান সামলে দিতে পারবো’। মেয়ের সেই প্রস্তাব শোনা মাত্রই তাঁর বাবা বাতিল করে দিলেন। অতটুকু পুচকে নারদ মুনি? তা আবার হয় নাকি, দেখতে কেমন লাগবে? কিন্তু মেয়ে বায়না ধরলো। তাঁর বাবা শেষমেশ রাজি হতে বাধ্য হলেন। সেদিন সেইমেয়ে যে অভিনয় আর গান দর্শকদের সামনে হাজির করলো তাতে তারা দারুণ খুশী হয়ে ফের সেই মেয়ের গান ও অভিনয়ের দাবি জানালো। 

শুরু হল বাবার নাটকে গান আর অভিনয়। কিন্তু তাঁর বাবা সেই ঘটনার পর খুব বেশী দিন পৃথিবীতে রইলেন না। এরপর ১৩ বছর বয়সী মেয়ের ঘারের ওপর এসে পড়লো গোটা পরিবারের দায়িত্ব। তখন পাশে এসে দাঁড়ালেন তার বাবার এক ঘনিষ্ট বন্ধু। তিনি নবযুগ চিত্রপট সিনেমা কোম্পানির মালিক। তিনি মেয়েটিকে গান আর অভিনয় শিখিয়ে মারাঠি সিনেমায় সুযোগ দিতে চাইলেন। সেই মতো শুরু হল শেখার কাজ তারপর মেয়েটিকে কিছু কাজ দেওয়ারও চেষ্টা করলেন চিত্রপট সিনেমা কোম্পানির মালিক।কিন্তু শুরুতেই মারাঠী সিনেমায় গাওয়া মেয়েটিরপ্রথম গান ‘খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ সিনেমা থেকে বাদ পড়ে গেল। তবে এই ঘটনাতেও মেয়েটি হতাশ হল না।

এরপরও মেয়েটি মাঝে মধ্যেই মারাঠি সিনেমায় গান গাওয়ার আর অভিনয় করার সুযোগ পেতে থাকেন। কিন্তু সিনেমার সংসার তাঁর ভাল লাগে না। কিন্তু কিছু করার নেই। সিনেমার কাজ না করলে রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। সেটা হলে গোটা পরিবারকে উপবাসে থাকতে হবে। একদিন হিন্দি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেল মেয়েটি। বসন্ত যুগলকরের ছবি ‘আপ কি সেবা ম্যায়’, আর গান-‘পা লাগো কার জোরি’। এই গানটি ছিল লতা মঙ্গেসকরের গাওয়া প্রথম হিন্দি ছবির গান।

লতা মঙ্গেসকরের সিনেমার গানের গুরু ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার। নিজের ৮৪তম জন্মদিনে লতা বলেছিলেন, গুলাম হায়দার তার জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’ গানটি গাওয়ার সুযোগ এসেছিল গুলাম হায়দারের হাত ধরেই।আর সেই গানেই তিনি বলিউড ইন্ডাস্ট্রিকে তাঁকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করিয়েছিলেন। তবে লতার সঙ্গীত জীবনের প্রথম সুপার হিট গান ছিল ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ ছবিতে ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। সেই গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন মধুবালা।

Jyoti Basu at a function to celebrate 300 years of Calcutta. On his right Lata Mangeshkar and on left Asha Bhonsle and R.P. Goenka.

মাত্র তিন বছর বয়সে লতা মুম্বাইতে এসেছিলেন।তখন তাঁকে মুম্বাইয়ের স্কুলেও  ভর্তি করা হয়েছিল।কিন্তু লতার স্কুল জীবনের বয়স ছিল মাত্র দু দিন। তারপরই শেষ হয়ে যায় তার স্কুল জীবন। প্রথম দিন স্কুল শিক্ষক তাঁকে হাত ধরে লিখিয়েছিলেন। তাতে খুব মজা পেয়েছিলেন। কিন্তু তারপরের দিন বোন আশাকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে গেলে সেই শিক্ষক লতাকে খুব বকেছিলেন। শিশু লতার এত খারাপ লেগেছিল, যে তারপর আর তিনি স্কুলে গেলেন না।পড়াশুনা বলতে যা কিছু তা বাড়িতেই।

সঙ্গীত জীবনের লম্বা সফরে নিজের কোন গান কতবার শুনেছেন? কোনওদিন একবারের জন্যও না। লতার কথা অনুযায়ী,শুনলেই তাঁর মন খারাপ হয়ে যাবে। মনে হবে, এটা এভাবে না করে অন্যভাবে করলে ভাল হত। মনে হবে, এই সুরটা অন্যরকম হতে পারত। তাই নিজের গান থেকে লতা দূরে দূরেই থেকে গিয়েছেন।

হিসেব জানাচ্ছে লতার গানের কেরিয়ারের বয়স প্রায় ৭৫ বছর। এতগুলি দিনে কতবারযে তাঁকে রেকর্ডিংয়ে যেতে হয়েছে তার হিসাব এখনও জানা যায় নি। তবে সারা জীবনে তিনি মাত্র দুই থেকে তিন দিন ঠিক সময়েরেকর্ডিংয়েপৌঁছতে পারেন নি। তবেকীকারণে দেরি হয়েছিলসেটা তাঁর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে ছিল।

স্টুডিওতে কোনও দিন চেয়ারে বসে গান রেকর্ড করেন নি। কারণ মনে করতেন গাইতে হলে দাঁড়িয়ে গাইতে হয়। আর যে দিন রেকর্ডিং থাকত সে দিন লতা প্রায় কিছুই খেতেন না। স্রেফ চা।

সেই তের বছর বয়সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রোজগার করতে শুরু করে নিজের কোনও রকম শখ, আহ্লাদ তিনি পূরণ করতে পারেন নি। কয়েক বছর পর একদিন যখন তার সুযোগ এল, তখন তিনি অনেক দিনের শখ মেটাতে একটি রেডিও কিনলেন। তাঁর বাবা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনও গান গাইতে বা শুনতে দিতেন না। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ছাড়া একমাত্র কে. এল. সায়গলের গান গাইতে বা শুনতে তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন। সায়গলের গান লতার অত্যন্ত প্রিয়।

বাবার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর, ১৯৪৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, আঠেরো বছর বয়সের কিশোরী লতা, নিজের রোজগারের টাকায়, জীবনে প্রথম রেডিও কিনলেন। বাড়ি এসে যখন নতুন রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন তখন রেডিওর খবরে শুনতে পেলেন কেএল সায়গল মারা গিয়েছেন। প্রিয় গায়কের মৃত্যু সংবাদ শুনে মনের দুঃখে তখনই লতা দোকানে গিয়ে রেডিওটি ফেরত দিয়ে আসেন।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version