বাংলাদেশের কবি সায়ীদ আবুবকর তাঁর গাছির গান কবিতায় লিখেছিলেন, “জিড়ন রসের মতো তোমার যৌবন, যূথীমালা;/ তোমার খেজুরগাছে আজ আমি দিনান্তের গাছি,/ কাটবো পৌরুষ দিয়ে তোমার দুচোখে যত জ্বালা,/ তারপর রস দিও, বসতে দেবো না কোনো মাছি”। চারপাশে যখন জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। সকাল হলেও কিন্তু সূর্যের দেখা নেই, তবু ঘন কুয়াশার মধ্যেই কিছু মানুষ আড়মোড়া ভেঙে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের মেঠো-প্রান্তরে। তাঁদের শরীরে প্যাঁচানো দড়ি, কোমরে বাঁশের ঝুড়ি, ভেতরে বাটাল-হাঁসুয়া। শরীরে ঝুলিয়ে রাখা মাটির হাঁড়ি নিয়ে তরতর করে বেয়ে ওঠেন খেজুর গাছে। খালি পাত্রটি বেঁধে দিয়ে নামিয়ে আনেন রসে টুইটম্বুর হাঁড়ি। শীতের সকালে গাছিদের এই দৃশ্য গ্রামবাংলায় খুবই পরিচিত।

গাছি গ্রামাঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন পেশা। শীত এলেই তাদের কদর বাড়ে। খেজুরের রস সংগ্রহে গাছ প্রস্তুত করতে অগ্রহায়ণেই দম ফেলার সময় থাকে না গাছিদের। গাছের ছাল-বাকল তুলে গাছি হাঁড়ি বাঁধার ব্যবস্থা করেন। শীতের আমেজ যতই গাঢ় হয়, গাছিদের মাটির হাঁড়ি তত কম সময়েই ভরে ওঠে খেজুরের রসে। শীতের সকালে এই খেজুরের রসের স্বাদ নিতে চায় বাঙালি। তাছাড়া এই সময়টা যেন অনেকটা পিঠাপুলিরও উৎসব। বাংলার ঘরে ঘরে এই সময় তৈরি হয় নানা রকম পিঠা। সেই পিঠার অন্যতম উপাদান খেজুর রসের লালি বা হালকা জ্বালানো রস ও গুড়। এছাড়া খেজুর গুড়ের তৈরি রসগোল্লা, পায়েস, মোয়া ও সন্দেশ খাদ্যপ্রেমীদের যেন অন্যরকম তৃপ্তি এনে দেয়।

বাংলায় এখন খেজুর গাছ অনেক কমে গেছে। তবু কোথাও কোথাও তুলনামূলকভাবে খেজুর গাছের সংখ্যা বেশ ভালো। খেজুর রসের স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি শীতে গাছিদের পুরো কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে হলে যেতে হবে শহরের সীমানা পেরিয়া গ্রামে। তেমন একটি গ্রাম দক্ষিন ২৪ পরগনার রায়দিঘি। সেখানে এমন কয়েকজন গাছির সঙ্গে কথা হলো যারা ৪০/৪৫ বছর ধরেই খেজুর রসের কারবার করছেন। বৃদ্ধ গাছি আব্দুর রউফের থেকে জানা গেল, অগ্রহায়ণের শুরুতে খেজুরের গাছ তোলা হয়। মানে গাছের মাথার দিকের এক পাশের ছাল-বাকল তুলে ফেলা হয়। এরপর কয়েক দিনে ছাল তোলা অংশটি শুকায়। অগ্রহায়ণের শেষে খেজুরগাছের ছাল তোলা অংশ চেঁছে ওপরের দিকে দু’টি চোখ কাটা হয়। তারপর ছাঁটা যে অংশে রস নিঃসরণ হয় সে অংশে ৭-৮ ইঞ্চি লম্বা চিকন বাঁশের কঞ্চির আধা ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিতে হয়। সর্বশেষ কাঠির মধ্যে দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় নির্গত রস গাছে ঝুলানো ছোট-বড় হাঁড়িতে সংগ্রহ করা হয়।

পৌষ-মাঘ মানে ডিসেম্বর-জানুয়ারি- এই দু’মাসেই সাধারণত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করেন গাছিরা। গাছি জলিল আহমেদ জানান, গাছ একবার ছাঁটলে ৩-৪ দিন রস সংগ্রহ করা যায় এবং পরবর্তী সময়ে ৩ দিন শুকাতে হয়। এরপর আবার হালকা ছেঁটে পুনরায় রস সংগ্রহ করা যায়। একটি গাছ থেকে দৈনিক গড়ে ৫ লিটার রস পাওয়া যায়। তবে এখন আর এক লিটার রস বিক্রি করে গাছিরা আগের মতো দাম পান না। কারণ গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গাছের মালিকেরা গাছিকে দিয়ে গাছ কাটিয়ে তার পারিশ্রমিক ধরে দেন, কেউ কেউ সঙ্গে এক হাড়ি রস। সেই রস অনেক সময় যারা গুড় তৈরি করেন তাঁরা কম দামেই কিনে নেন। 

খেজুর রসের কারবার এই অঞ্চলের মানুষের অন্তত দুশো বছরের প্রাচীন। বেশ কিছু বইয়ে এই খেজুর রসের কথা উল্লেখ রয়েছে। দ্য ডেট সুগার ইন্ডাস্ট্রি অব ইন্ডিয়া বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবারের মতো খেজুরের গুড় ব্রিটেনে পাঠানো হয়। এই গুড়ের চাহিদা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশ রমরমা ছিল। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস বইতে পাওয়া যায়, ১৯০০-০১ সালে পূর্ববঙ্গে খেজুরের গুড় তৈরি হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মণ, যা প্রায় ৮২ হাজার টনের সমান।

১৯৪০-এর দশকের প্রথম দিকে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনার হাওড়া, মেদিনীপুর এবং বাংলাদেশের ফরিদপুরে খেজুর গুড় শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। তৎকালীন সময়ে প্রতিবছর মোট ১,০০,০০০ টন গুড় উৎপাদন হত। সেই সময়ে, ১ বিঘা জমিতে ১০০টি গাছ লাগানো হত। সাত বছরের মধ্যে গাছগুলি ফল ও রস সংগ্রহের উপযোগী হত এবং ত্রিশ-চল্লিশ বছর পর্যন্ত চলত ফল ও রস সংগ্রহ। এরপর আর ওভাবে খেজুর গাছ লাগানোর উদ্যোগ দেখা যায়না। মূলত জমিতে খেজুর গাছ লাগালে আয় মাত্র তিন মাস, কিন্তু অন্য ফসল থাকে বারো মাস। এ জন্যই গাছের পাশাপাশি গাছিদের সংখ্যাও কমছে। কমছে খেজুর রসের উৎপাদনও।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version