তপন সিনহার ‘ঝিন্দের বন্দি’-র কথা যদি আসে তাহলে একথা মানতেই হয়, ঝিন্দের রাজা উত্তম আর ময়ূর বাহন সৌমিত্র দুজনেই সেই ছবিতে অভিনয় শিল্পকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। আরে বাবা রাজা যে নায়ক হবেন সে আর নতুন কি। আর নায়কের পাশাপাশি খলনায়কও আসবেন। কিন্তু কোনও কোনও খলনায়ক নায়ককে ছাপিয়ে যান। সেই লড়াই আমরা দেখেছি ‘ঝিন্দের বন্দি’-তে।
শুধু ‘ঝিন্দের বন্দি’ কেন, সলিল দত্তের ‘অপরিচিত’ ছবির সুজিত(সৌমিত্র)ও রঞ্জন(উত্তম), ‘স্ত্রী’-র মাধব দত্ত(উত্তম)ও সীতাপতি(সৌমিত্র, তরুণ মজুমদারের ‘যদি জানতেম’-এর কৌশিক(সৌমিত্র)ও পিকে বসু(উত্তম), দিলীপ রায়ের ‘দেবদাস’-এর দেবদাস(সৌমিত্র)ও চুনীলাল(উত্তম)নিয়ে আমরা যদি তর্ক না করে তুলনামূলক আলোচনাও করি, সেখানে লড়াই বা একে অপরকে টক্কর নেই। ‘ঝিন্দের বন্দি’র ময়ূর বাহণ যেমন সৌমিত্রকে ছাড়া ভাবা যায় না তেমনই সুজিত, সীতাপতি, কৌশিক চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এততটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন যে আমরা বিস্মিত বা আপ্লুত না হয়ে পারি না।
সমকালে সমান বা কাছাকাছি দুই প্রতিভাবান থাকলে তুলনা আসবেই। কিংবদন্তি উত্তমকুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের তুলনা সেরকমই স্বাভাবিক।তবে উত্তম কুমার পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার অনেক আগেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবদ্দশাতেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক, সুঅভিনেতা।
অপুর সংসার দারুণ সাড়া ফেললে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি সিনেমার ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপু ছাড়াও ফেলুদা চরিত্রেও অভিনয় করে সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন।মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের ছবিতেও সৌমিত্র নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছিলেন নিজের অভিনয় গুণেই।
অভিনয় তাঁকে বিপুল প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতি এনে দিলেও তাঁর নিজস্ব মনন বা চর্চার জগৎ থেকে একদিনের জন্যও সরে যান নি। ছাড়েন নি কবিতা লেখা, পাঠ। সমানতালে চালিয়ে গিয়েছেন লেখালেখি, সম্পাদনা ও মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা। একে একে ‘টিকটিকি’, ‘নামজীবন’, ‘রাজকুমার’, ‘নীলকণ্ঠ’-র মতো নাটক লিখেছেন ও মঞ্চে হাজির করেছেন তাঁর অভিনয় ও নির্দেশনায়। তাঁর কাব্য চর্চার ফসল ‘মধ্যরাতের সংকেত’, ‘হায় চিরজল’, ‘জন্ম যায় জন্ম যাবে’, ‘যা বাকি রইল’, ‘হে সায়ংকাল’এর মতো কাব্য গ্রন্থ।
তিনি যে বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি এ কথা নতুন নয়। এই উপমহাদেশে যে ক’জন অভিনেতা নিজস্ব মেধা আর দক্ষতায় অভিনয়কে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। কেবল তাই নয়, বাংলা সিনেমার মহানায়কের কালেও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র একজন অভিনেতা। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার কারণেএই মানুষটি বাঙালির হৃদয়ে আলাদা সম্মান আর সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।
অধিকাংশ বাঙালি তাঁকে রূপালি পর্দার নায়ক কিম্বা অন্যধরণের অভিনেতা হিসাবেই চেনেন। অনেকেই আবার তাঁর বহুমুখী প্রতিভার খোঁজখবর রাখতেন। তিনি নাটক লিখতেন, মঞ্চে নাটক পরিচালনা ও অভিনয় করতেন, সমাজ-সাহিত্য ও শিল্প বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনাতেও নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন, এছাড়া তাঁর কাব্য প্রতিভার পরিচয় মেলে প্রকাশিত একাধিক কাব্যগ্রন্থে। অনেক দেরিতে হলেও তিনি রঙ ও রেখায় মনোনিবেশ করেছিলেন। এমন একজন মননশীল মানুষ বন্ধুমহলে ছিলেন তুখোড় আড্ডাবাজ।