কলকাতা ব্যুরো: কুলতলির কেল্লার জঙ্গলে ছ দিন ধরে মানুষকে নাকাল করার পর অবশেষে মঙ্গলবার সকালে ধরাশায়ী হল বাঘ। এই নিয়ে এক মাসের মধ্যেই কুলতলিতে গ্রামে ঢুকে পড়া দুটি বাঘকে উদ্ধার করতে সক্ষম হল বনদপ্তর। এই প্রসঙ্গে সুন্দরবনের বাঘেদের গতিবিধি নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। নদী পেরিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘটিকে গত কয়েকদিন ধরে খাঁচায় পুরতে যত রকম পথ নেওয়া যায়, সব চেষ্টাই করেছিল বনদপ্তর। কিন্তু তাতেও বাঘটি চোর-পুলিশ খেলা ছেড়ে পুরোপুরি ধরা দেয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রায় নজিরবিহীনভাবে নির্দিষ্ট জঙ্গল চিহ্নিত করে চারিদিক থেকে জাল দিয়ে ঘিরে দমকলের হোস পাইপ থেকে জল দিয়ে আপাতত তাকে মানুষের সামনে আনতে সক্ষম হয়েছেন বনকর্মীরা। তারপরেই পরপর ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে কাবু করা গিয়েছে বাঘটিকে।
এতদিন ধরে না হলেও সুন্দরবনের বাঘ লোকালয়ে একবার বেরিয়ে পড়লে তাকে জঙ্গলে ঢোকাতে বেগ পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। ২০০৯ সাল নাগাদ ঝড়খালিতে এমনই এক বাঘের উৎপাতে নাকাল হতে হয়েছিল বাসিন্দা থেকে বনকর্মীদের। জঙ্গল থেকে হেরোভাংগা নদী পেরিয়ে এমনই এক শীতের দিনে সে ঢুকে পড়েছিল লোকালয়। যেহেতু ঝড়খালির গ্রামগুলিতে প্রচুর জঙ্গল রয়েছে, ফলে সে অনায়াসেই আস্তানা গাড়ে ছোট ছোট জঙ্গলের মধ্যে। অন্তত দুদিন এই জঙ্গল ঘিরে শেষ পর্যন্ত ছাগল টোপ করে পাতা খাঁচায় ধরা পড়ে যায় সেই বাঘ। যদিও খাঁচায় ঢোকার পরে যখন তার গেট উপর থেকে নেমে যায় তাতেই আঘাত পেয়েছিল বাঘটি। সেই জখম পায়ে চিকিৎসা করাতে তাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল চিড়িয়াখানায়।
গত কয়েক দশক ধরেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাঘ গ্রামে ঢুকে পড়লে আবার তাড়া খেয়ে জঙ্গলে ঢুকে বেরিয়ে যাবার ঘটনা হামেশাই ঘটে থাকে। কিন্তু ২০০৮ সালে কুলতলির গ্রামে ঢুকে পরা বাঘ সেই সময়ে বনদপ্তরকে বেগ দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। বাঘটি কয়েকদিন ধরেই গ্রামের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল বলে স্থানীয়রা খবর দিয়েছিলেন বনদপ্তরকে। একদিন সকালে কোণঠাসা করতে করতে যখন বাঘটিকে জালে ফেলার মত অবস্থা এল, তখন চকিতে বাঘ দৌড়ে উঠে পড়ল এক তাল গাছে।
তারপর কয়েক ঘন্টা ধরে সেই তাল গাছের উপরে বসে রইল বাঘ। বলা ভালো তাল গাছের উপরে উঠে আটকে পড়ল বাঘ। কেননা এত বড় শরীর নিয়ে মানুষের ভয় কোনরকমে তাল গাছে উঠে পড়লেও, সেখানে গাছের উপর এমনভাবে দেহটি আটকে যায়, যে অনেক চেষ্টা করেও প্রথমে নামতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত পেছন থেকে ঘুমপাড়ানি গুলি ছোড়া হয়। তারও কয়েক ঘন্টা পরে হঠাৎ করেই সেই গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে সামনের পুকুরে। তখনই তাকে জালে বেঁধে তোলা হয়।
সুন্দরবনের গ্রামগুলিতে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের বসবাস। কিন্তু তার বহু গ্রাম পুরোপুরি জঙ্গলের মধ্যেই রয়েছে। সরকারিভাবে বাঘেদের চিহ্নিত এলাকা আলাদা হলেও, মাঝেমাঝেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঢুকে পরে সেইসব গ্রামে। বাঘ ঢোকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্পর্শ কাতর এলাকা, একদিকে গোসাবার কয়েকটি দ্বীপ, অন্যদিকে কুলতলির নির্দিষ্ট কিছু গ্রাম। যেগুলি নদীর ধারে অবস্থিত। তবে সদ্য ধরা পড়া বাঘটি এমন এলাকায় ঢুকে পড়েছিল যা আগামী দিনে বনদপ্তর এবং চিন্তা বাড়িয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। এই এলাকায় আগে সেভাবে কোনদিন বাঘের আনাগোনা দেখা যায়নি কারণ এই এলাকা অনেকটাই মূল জঙ্গল থেকে দূরে। ফলে বাসটি এতদূর জঙ্গল ছেড়ে চলে আসায় স্বভাবত তার গতিবিধি নিয়ে চিন্তা বাড়াচ্ছে। একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভাগ্যিস ছ দিনের মাথায় ধরা পরলো। না হলে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু ছিলনা।
সাধারণভাবে একটি বাঘ পেট ভরে খাবার পরে পাঁচ – ছ দিন অনায়াসে থাকতে পারে। সেই ভাবে ধরলে বাঘটি যখন লোকালয়ে ঢুকে ছিল তার আগেই সে পেটভরে খেয়েছিল। এই কদিন লোকালয়ের জঙ্গলে থাকলেও, সেই অর্থে তার খাওয়ার কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ফলে খিদে তার বার ছিল। এই অবস্থায় হঠাৎ করে সে হামলা চালালে বিপদ হতে পারত।