সারাজীবন ধরে পরিবেশ রক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ পদ্মশ্রী সম্মান তুলে দেওয়া হয়েছেতাঁর হাতে। তিনি কর্নাটকের হালাক্কি আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত ৭২ বছর বয়সী তুলসী গৌড়া। তিনি চরম দারিদ্রতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি। অথচ রীতি মতো জানেন,কোন গাছটার কতটা জল দরকার, কোন গাছের কি সমস্যা, কোন গাছ চারা তৈরির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত, কোন গাছের কি কি গুনাগুন, কোন বীজগুলি কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে ইত্যাদি।
গত ছ’দশক ধরে এই সব কাজের জন্য তাঁকে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফরেস্ট’ বলা হয়। তার থেকেও বড় কথা বিগত ষাট বছরে তিনি প্রায় ৩০ হাজার গাছকে সন্তান স্নেহে লালন পালন করেছেন। কিন্তু আসমুদ্র হিমাচল যে হইচই শুরু হয়েছে;তা এসবের জন্য যত না তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর আদিবাসী গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে খালি পায়ে লাল কার্পেটের ওপর দিয়েহেঁটে আসা নিয়ে।
তুলসীর আগেগত ৮০ বছরে প্রায় ৮ হাজার গাছ পুঁতে তাদের বড় করে তুলেছিলেন ১০৬ বছর বয়সী কর্নাটকের আরেক বৃক্ষমাতা থিম্মাকা। তাঁরও স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।বিয়ের ২৫ বছর পরেও কোনও সন্তান না হওয়ায় সমাজ তাঁকে একঘরে করে দিয়েছিল। সেই থিম্মাকাকেপদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয় পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের কারণেই।
কর্নাটকের গুব্বি তালুকের ভূমিহীন দিনমজুর দম্পতি বেকাল চিক্কাইয়া আর থিম্মাক্কা সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গাছ লাগানোর কথা, পৃথিবীকে সবুজে ভরে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। প্রথম বছরে ১০টি, দ্বিতীয় বছরে ১৫টি, তৃতীয় বছরে ২০টি বটগাছের চারা লাগালেন তাঁরা। এক সময় এই সন্তান সন্ততিদের দেখভালের জন্য দিনমজুরির কাজও ছেড়ে দেন চিক্কাইয়া। কেবল থিম্মাক্কার রোজগারে চলতো সংসার।
প্রতিদিন প্রায় চার কিলোমিটার পেরিয়ে তারা ওইসব গাছগুলোতে জল দিতেন। গবাদি পশুর হাত থেকে চারাগাছগুলোকে বাঁচাতে কাঁটাতারের বেড়া বানাতেন। প্রায় চার কিলোমিটার পথজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াময় সুবিশাল গাছগুলো যে থিম্মাক্কার ভালোবাসারই কারণেই বেড়ে উঠেছে এবং ডালপালা মেলেছে তা আজ আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না। এরপর চিক্কাইয়া চলে যাওয়ায় একলা হয়ে পরলেন থিম্মাক্কা। কিন্তু ভেঙে পড়লেন না, একলা লড়াই চালিয়ে গেলেন।
থিম্মাক্কা একাই অতগুলি সন্তানদের পরিচর্যার ভার কাঁধে তুলে নিলেন। একঘরে, একলা হয়ে যাওয়া থিম্মাক্কার দৃঢ় মনোভাব সেদিনএকটুও টাল খায়নি। যে পরিবার ছিল একঘরে; সেখান থেকেই থিম্মাক্কার কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে গ্রামবাসীরাই তাকে একদিন ‘সালুমারাদা’, বলে ডাকতে শুরু করলেন। কন্নড় ভাষায় যার অর্থ ‘গাছেদের সারি।’
এলাকার সালুমারাদাথিম্মাক্কা তারপরও লোকচক্ষুর আড়ালেই রয়ে যেতেন। যদি না স্থানীয়দের মাধ্যমেই তার কথা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে না পড়ত। যারা একদিন তাঁকে বন্ধ্যা বলে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল তারাই শেষপর্যন্ত হয়ে উঠল থিম্মাক্কার প্রচার মাধ্যম।১৯৯৬ সালে ‘জাতীয় নাগরিক সম্মান’ ভূষিত হওয়ার পর তার কথা জানতে পারে গোটা দেশ। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।
এরপর থিম্মাক্কার সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব নেয় কর্নাটক সরকার। এ প্রসঙ্গে তার নিজের বক্তব্য অবশ্য অন্য, তিনি মনে করেন; সন্তানদের প্রতিপালন নিজে করতে পারলেই তিনি খুশি হতেন। কারণ কখনোই কারও সাহায্য চাননি তিনি।আন্তর্জাতিক স্তরের উদ্যোগে থিম্মাক্কা ফাউন্ডেশনেও তৈরি হয়েছে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ খুনের প্রতিবাদ সভাতেও থিম্মাকাকে দেখা গিয়েছিল।গত ৮০ বছরে প্রায় ৮ হাজার গাছ পুঁতে তাদের বড় করে তুলেছেন ১০৬ বছর বয়সী এই বৃক্ষমাতা। থিম্মাকাকেও পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয় পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের কারণেই। তাছাড়া আন্তর্জাতিক স্তরেও বহু পুরস্কার পেয়েছেন এই বৃক্ষমাতা।তাই প্রশ্ন জাগছে তুলসী বা থিম্মাকা পদ্মশ্রী বা কোনও পুরস্কারের অপেক্ষায় কি ছিলেন কখনো ?
3 Comments
প্রথম মায়ের কথা কয়েকদিন আগে খবরেই জেনেছি, অন্যজনের কথা জানালেন লেখক। এমন মায়েদের শত কোটি প্রণাম।
এমন মায়েদের শত কোটি প্রণাম।
হাজার সেলাম, লক্ষ প্রণাম দিয়েও কি তোমাদের ঋণ শোধ হবে মা! আমাদের ক্ষমা করে দিও।