জীবনহানী এবং ঘরবাড়ি-জমিজায়গা লণ্ডভন্ড করে দেওয়া বিধ্বংসী ঝড় আগাম খবর দিয়ে এলেও কখনো শাসক দলের রাজনীতির রঙ দেখে ঝাপিয়ে পড়ে না। তবে বাংলায় ঝড়জলে বিপন্ন মানুষের ত্রাণ নিয়ে যে রাজনীতি হয় সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। ঝড়ে ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়ানো দিশেহারা মানুষ কিংবা বানভাসি মানুষের ত্রাণ নিয়ে শাসকদলের নেতা মন্ত্রী এবং তাঁদের অনুগামী ফড়ে দালালদের বিরুদ্ধে চুরিজোচ্চুরির অভিযোগ ওঠে এই বাংলাতেই। ত্রাণ নিয়ে হয় কাদা ছোড়াছুড়ি। অর্থাৎ দুর্গত মানুষের ক্ষতিপূরণ নিয়েও চলে রাজনৈতিক চাপান উতোর। অন্য সব ক্ষেত্রেই যেমন দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ এবং পাল্টা আকচা-আকচি চলে বাদ যায় না ঝড়জল বা দুর্যোগের ত্রাণ নিয়েও। সে ‘আয়লা’, ‘আমফান’, ‘যশ’ যাই হোক না কেন মানুষের অপরিসীম দুর্ভোগের মধ্যেও রাজনীতি আর দুর্নীতি চলে সমান তালে।

অনেকেই বলেন ‘ত্রাণ’ একটা ‘টপ-ডাউন’মনোভাবের ফল। যার পিছনে ‘সিস্টেম’কে রক্ষার পরোক্ষ তাগিদ থাকে। বিপরীতে ‘পারস্পরিক সহায়তা’একটা আনুভূমিক প্রক্রিয়া। মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে সেখানে। কার্যত সেটাই হওয়ার কথা। সমাজে কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা এগিয়ে আসবে– এটা সভ্যতার সমান ঐতিহ্য। পারস্পরিক সহায়তার ওপর ভর করেই মানুষ এগিয়ে চলে। এই শক্তি মানুষের অগ্রগতির গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। পারস্পরিক সহায়তার ধারণায় ভিন্নমতও আছে। একদল মনে করে, দুর্যোগ বা সংকট সামাল দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মীদের জোর দেওয়া উচিত দুর্যোগকবলিত মানুষের দায়িত্ব নিতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করার ওপর। অবশ্যই দুর্যোগে রাষ্ট্রেরই মানুষকে রক্ষার মূল কাজ। এই অর্থে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ্ধতিও বটে।

কিন্তু দেখা গিয়েছে বাংলার উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড়ড়ে যখন কার্যত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জনজীবন, অসংখ্য ঘর ভাঙে, জলের তলায় চলে যায় বিঘের পর বিঘে চাষের জমি। প্রশাসনের তরফে প্রাথমিক ভাবে ত্রাণ, ত্রিপলের ব্যবস্থা হলেও সেই ত্রাণ বিলি নিয়েই সামনে আসে একের পর এক মারাত্মক সব অভিযোগ। অভিযোগ ওঠে, গরিব মানুষের ত্রাণ বিলি নিয়ে দুর্নীতি করেছেন শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরাই। চাল-ত্রিপল চুরির পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাতের একাধিক অভিযোগ ওঠে। বলাইবাহুল্য শাসক দল অভিযোগ অস্বীকার করে। এমনকি অন্যান্য দল যেখানে পঞ্চায়েতে ক্ষমতায়, সেখানেও ওঠে একই অভিযোগ। কোথাও প্রধানেরা ঘেরাও হন, বিক্ষোভ হয় পঞ্চায়েতে।

আমপান, ফণী, বুলবুল, ইয়াস, রেমালের মতো একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের পর দুর্গতদের বঞ্চিত করে ত্রাণের সামগ্রী খোলাবাজারে পাচার করে এক শ্রেণির নেতা পকেট ভরার কারণে আরেক ঘূর্ণিঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে সেই ত্রাণ-কেলেঙ্কারিই চিন্তা বাড়াচ্ছে উপকূলের মানুষজনের। প্রকৃতির হাতে সব হারাতে হলে, প্রশাসনের প্রাপ্য সাহায্যটুকু ঠিক মতো হাতে পাবেন কিনা, তা নিয়ে আশঙ্কা ভীড় করছে সেই সব মানুষের মনে। তাঁদের কথায়, দুর্যোগ ঘনালেই যেন খুশি হন রাজনীতির কারবারিদের অনেকে। বিপদ হলে পরিত্রাণের জন্য আসবে ত্রাণ। আর তা থেকে পকেট ভরবে তারা— এই তো চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে! একাধিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কথায়, কোনো বিপর্যয় হলে তাঁদের জন্য সরকার যতটা ত্রাণ পাঠায়, তার সবটা এসে পৌঁছয় না। মাঝপথে বিভিন্ন স্তরের নেতারা ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি ও দুর্নীতি করে। অনেকে বলেন, ত্রিপল থেকে শুরু করে ক্ষতিপূরণের টাকা শাসক দল তাদের পছন্দের লোকজনকেই দিয়ে থাকে। দিনের পর দিন বেহাল বাঁধ মেরামতে উদ্যোগ নেয়না প্রশাসন। অথচ সেই বাঁধ কংক্রিটের না হলে সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা থেকেই যায়, প্রতিটি দুর্যোগেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হয় তাঁদের।

দেখা যাচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়-জলের মতো দুর্যোগে যখন সাধারণ মানুষ বিপন্ন হয়, জীবন ধারণ যখন ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই শাসকদলের আশেপাশে ঘুরঘুর করা ধান্দাবাজরা ত্রাণে সক্রিয় হয়ে ওঠে কেবলমাত্র নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। এই বাস্তবতা সব আমলেই কম বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন বামেদের বিরুদ্ধেও যে ত্রাণ বিলি, বাঁধ তৈরির টাকা নিয়ে অভিযোগ ওঠেনি সেকথা মিথ্যে বলে সরিয়ে দেওয়া যাবে না। বিরোধী দলের নেতানেত্রীরা সেই সময়ে তা নিয়ে বিস্তর গলা ফাটিয়েছেন। শাসকেরা তখন সেই ঘটনায় সাফাই দিয়েছেন, ছোটখাট ভুলভ্রান্তি হত একটা বড় দুর্যোগের সময় হতেই পারে, তা নিয়ে রাজনীতি করাটা ঠিক নয়। ঠিক নয় বলেই দুর্যোগের পরে দুর্নীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। তার মানে দেখা যাচ্ছে, শাসক দল বা তাদের নেতারা কেউই দুর্নীতির অভিযোগ মানতে নারাজ। সব শাসকই বলে থাকেন, ত্রাণ বিলি নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক নয়। সরকারি পদ্ধতিতেই ত্রাণ বিলি হয়। পঞ্চায়েত স্তরে তো বিরোধী সদস্যেরাও থাকেন। তাঁরাও ত্রাণ বিলিতে অংশ নেন। শাসক ও দলের নেতারা এও বলেন কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে বিরোধীদের তো এলাকায় দেখা যায় না। মানুষের জন্য যাঁরা কাজ করে, তাঁদের কিছু ভুল হয়। কিছু দুর্নামও ছড়ায়।
