তপন মল্লিক চৌধুরী

সুকুমার রায় কি কেবল বাংলা শিশুসাহিত্যকেই সাবালক করেছিলেন।অন্তত বুদ্ধদেব বসুরকথা অনুযায়ী ‘বিশেষভাবে সাবালকপাঠ্য’।তবেসুকুমারের লেখালিখিশুধুশিশুদের নয়,আচ্ছন্ন করে বড়দের চেতনাকেও।তাঁররচনার আবেদন উদ্ভট, আশ্চর্য জগৎ কিংবা হাস্যরসিকতার মধ্যেই ফুরিয়ে যায় না। সেই আশ্চর্য ও বিস্ময়ের জগত গড়তে সুকুমার সঙ্গে নিয়েছিলেনজীবজন্তুদেরও।তাঁর এই আশ্চর্য ভূবনে সবাইকে আগ্রহী করেন যেমন, নিজেকেও ব্যতিক্রমী করে তুলেছিলেন। তাঁর এই সব লেখায় যেউদ্ভট কর্মকাণ্ড তার একটা বড় কারণ বিচিত্র জীবজন্তুর আকার-আকৃতিগত প্রকৃতি ও চরিত্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংমিশ্রণ। সুকুমার তাঁর লেখায় এমন সব জীবজন্তুকেনিয়ে এসেছেন এবং তাদের কাহিনি বলেছেন সেসব শুধু ছোটদের কেন সাধারণ পাঠকদেরও কৌতূহল উদ্রেক করে। সুকুমারের ভাবখানা যেন, সামনে অথবা বহুদূরে রয়েছে সেই দুনিয়া, চাবি খুলে চলে এস আমার সঙ্গে...

‘প্লাটন’, ‘পেকারি’, ‘বিদ্যুৎ  মৎস্য’, ‘সমুদ্রের ঘোড়া’, ‘বীভার’, ‘হর্নবিল’, অস্ট্রেলিয়ার ‘বোয়ার বোর্ড’- এমন আরও কত বিচিত্র জীবজন্তুদের তিনি হাজির করেছেন। সেই সঙ্গে উঠে আসে বিচিত্র খেচর, স্থলচর ও জলচর প্রাণীরা। সুকুমার দেশি-বিদেশি এই সব জীবজন্তুর কাহিনি পরিবেশন করেন বাঙালি জীবনচর্যার সঙ্গে সংগতি রেখেই। এছাড়াও সেই কথা-কাহিনিতে রাখতে ভোলেননি বহুদিনের সংস্কার, লৌকিকতা এমনকি ইতিহাস। তাঁর সময়ের অশান্তবাংলার অস্থিরতাকে যেন খানিকটা পাশ কাটিয়ে সুকুমার তাঁর লেখায় চিরন্তনমানববৃত্তির চর্চাকেই সামনে  নিয়ে আসেন। আর সেই কাজে ‘সেকাল’ আর ‘একালে’র দ্বন্দকে কার্যকর করেন  ‘সেকালের বাঘ’, ‘সেকালের বাদুড়’ ইত্যাদিতে। অন্যদিকে ‘আলিপুরের বাগানে’, ‘মানুষমুখো’, ‘লড়াইবাজ জানোয়ার’, ‘নিশাচর’, ‘সিংহ শিকার’ এমনও। সময়ের দ্বান্দ্বিক জটে ইতিহাসের সঙ্গে সমকালের পরিবর্তনশীল সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রায় সকলেই সুকুমার রায়ের এই আশ্চর্য দুনিয়ার কথায় লুইস ক্যারলের প্রসঙ্গ টেনে আনেন।একথা ঠিকই, ইউরোপে যন্ত্রযুগের সুচনায়রাষ্ট্রব্যবস্থাএকই ছাঁচে ঢালাই করা মানুষ তৈরির লক্ষ্য নিয়ে যখন আগ্রাসন-অনুশাসনের ঘেরাটোপ তৈরি করছিল, ‘লুইস ক্যারলের যুক্তিচালিত বিস্ময়বোধ’তারই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া, অন্যদিকে ‘ব্যক্তিবাদের পরাকাষ্ঠা’এডওয়ার্ড লিয়রের লিমেরিকগুচ্ছও একই ঘটনার ফল। সুকুমারের লেখাগুলির অপার বিস্ময়বোধেসেই যুক্তিচালিত মন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে সক্রিয় এবং সুকুমার নিজেও হয়ে ওঠেনব্যতিক্রমী।

এই আশ্চর্য জগৎ কি অ্যালিসের ওয়ান্ডারল্যান্ড? তা একেবারেই নয়,  এই আশ্চর্য ভূবন বাস্তব ভূগোলের দৃশ্যমান জগৎ; বর্ণনার আশ্চর্যে তারা জলছবির মতোভেসে ওঠে।বিদ্যুৎ মাছের কথাই যদি বলি, যার ইংরেজি নাম Electric Eel, বাংলায় ‘বৈদ্যুতিক ঈল’। বিশালাকৃতির বান মাছের মতো সেটি প্রায় পাঁচ-ছ হাত লম্বা এবং ধারালো দাঁতবিশিষ্ট। জলজ প্রাণীটির প্রধান ক্ষমতা তার শরীরের মধ্যেকারবিদ্যুৎ। আসলে তারপিঠ থেকে লেজ পর্যন্ত শিরদাঁড়ার দুপাশে ছোট ছোট এরকম কোষ, যেগুলির মধ্যে রয়েছে এক ধরনের আঠালো রস। তার বৈদ্যুতিক অস্ত্র হল সেটি। আফ্রিকায় একধরনের মাছ আছে যার সমস্ত শরীরটাই বিদ্যুতের কোষে ঢাকা- নাম ‘রাদ্’ বা ‘বজ্র মাছ’।

সুকুমার সমুদ্রের ঘোড়ার কথা বলেছেন, যা আসলে মাছ। বর্মধারী মাছটি নল মাছের বংশধর, সমুদ্রের তলায় রঙিন বাগানে রং-বেরঙের ঝালর দুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এদের অভ্যাস হল, নিজেদের বাচ্চাকাচ্চার দলকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরা। মাছের মতো কুমিরের মতো প্রাণীদের অজানা অদ্ভুত জগতের কথাও বলেছেন তিনি। মাদাগাস্কারের টিকটিকি, মেক্সিকোর বিষধর গিরগিটি, মালয়দেশ ও ফিলিপাইন দ্বীপের উড়ুক্কু গিরগিটি- এ সবই বিচিত্র প্রকারের সরীসৃপ। সুকুমারের অদ্ভুত জগতে আছে সিন্ধু ঈগল– ‘সমুদ্রের ধারে যেখানে ঢেউয়ের ভিতর থেকে পাহাড়গুলো দেয়ালের মতো খাড়া হয়ে বেরোয় আর সারা বছর তার সঙ্গে লড়াই করে সমুদ্রের জল ফেনিয়ে ওঠে, তারি উপরে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের চূড়ায় সিন্ধু ঈগলের বাসা… তারা স্বামী-স্ত্রীতে বাসা বেঁধে থাকে।’

শুধুকি তাই, আমরা চমকে উঠি যখন সুকুমারগোটা দুনিয়ার ‘পাখির বাসা’র বৈচিত্র্যময় সম্ভার আমাদের সামনে হাজির করেন। ‘কেউ বানায় কাদা দিয়ে, কেউ বানায় ডাল-পালা দিয়ে, কেউ বানায় পালক দিয়ে, কেউ বানায় ঘাস দিয়ে; তার গড়নই বা কতরকমের… এক একটা পাখির বাসা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়, তাতে বুদ্ধিই বা কত খরচ করেছে আর মেহনতই বা করেছে কত।’ লক্ষ্যনীয়, সুকুমার পরিচিত ভূগোলের অপরিচিত জীবজন্তুর কার্যকলাপের অনুসন্ধানে যেমন সরল মনের পরিচয় রেখেছেন তেমনই সৌন্দর্যময় রূপজগৎকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেনগল্পবর্ণনার ভঙ্গীতেই। কিন্তু কোনো জায়গাতেই জীবজন্তুর বর্ণনায় দেব-দেবীর বা ধর্মীয় কল্পলোককে প্রশ্রয় দেননি। আধুনিক অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে শিল্পী মনের নিবিড় মেলবন্ধন থাকলেইএটাপারা সম্ভব। এরপর তাঁর ঝরঝরে ভাষার সঙ্গে পরিমিতব্যঙ্গের মিশেলে স্মরণীয় হয়ে ওঠেন সুকুমার।

সুকুমারেরআশ্চর্য জগৎ নির্মাণের ক্ষমতা সহজাত।কিন্তু তাঁর ফ্যান্টাসি? সেখানে কিন্তু তাঁর সমাজদৃষ্টি যতটা তীক্ষ্ণ তেমনি পর্যবেক্ষণশক্তি। বৈঠকি মেজাযে গল্পের মতো করেই তিনি বলে যান পৃথিবীর নানা প্রান্তের জীবজন্তুর কথা। অথচ জীবজন্তুকেন্দ্রিক গল্পগুলির মধ্যেও এনেছেন ব্যঙ্গের ছল,  সেটিও এসেছে তাঁর গভীর সমাজদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির কেরণে। যেমন ‘গোখরা শিকার’- এক সাহেবের আস্তাবলে গোখরা সাপ ধরার সমস্যার সমাধান করছে দেশি অশিক্ষিত চাপরাশি। আবার ‘খাঁচার বাইরে খাঁচার জন্তু’-খাঁচার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পোষ-মানা হরিণ, টিয়াপাখি, সিংহরা কেমন বিপন্ন বোধ করে, আবার বাইরে এসে কীভাবে দ্রুত সেই খাঁচার আশ্রয়ে ফিরে গিয়ে হাঁফ ছাড়ে। বুঝতে অসুবিধা হয় না বশ্যতা ও পরাধীনতা কেমনভাবে মনের গভীরে গেঁথে যায় এ তারই গল্প। ‘তিমির ব্যবসা’-কীভাবে যুদ্ধের সময়ে খাদ্য সমস্যা মেটাতে আমেরিকা তিমির মাংস লাগু করে। এমনকি বক্তৃতা, লেখালেখি, চলচ্চিত্র ইত্যাদির মাধ্যমেও প্রচার চলতে থাকে।সুকুমার জীবজন্তুর পরিচয় করানোর পাশাপাশি ইতিহাস, ভূগোল ও সমাজতত্ত্বের প্রাথমিক পাঠকেও অনুষঙ্গ করেছেন।

Share.

2 Comments

Leave A Reply

Exit mobile version