কলকাতা ব্যুরো: বাঘ বাঁচিয়ে নজির গড়লো ভুবনেশ্বরী গ্রাম। মঙ্গলবার সকাল থেকে মাঠে মাঠে ফলে থাকা সোনার ফসলের ক্ষেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রায় ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছিল সুন্দরবনের একটি বাঘ। জঙ্গল থেকে নদী পেরিয়ে মৈপীঠ কোস্টাল থানা এলাকার ওই গ্রামে ঢুকে ধানক্ষেতে ঘাপটি মেরে ছিল সারাদিন ধরে। মানুষের সঙ্গে প্রায় চোর-পুলিশ খেলার পর, রাত সাড়ে নটা নাগাদ বাবাজি ধরা পড়ে পেতে রাখা খাঁচায়। গভীর রাতে পূর্ণবয়স্ক সেই বাঘটিকে বনদপ্তর নিয়ে যায় শুশ্রূষার জন্য। তবে বাঘটি পুরোপুরি সুস্থ বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করছেন বনদপ্তরের আধিকারিকরা।
জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাঘ ধরে ফেলে নৃশংস ভাবে তাকে পিটিয়ে মারার ইতিহাস রয়েছে সুন্দরবনে। এমনকি কয়েক বছর আগেও এমনভাবে নদী পেরিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়া বাঘকে বাকের লাঠি দিয়ে মেরে রক্তক্ষরণের সাক্ষী রয়েছে কুলতলীর গ্রাম। আবার জালে ধরা পড়া বাঘের লোম, গোঁফ ছিড়ে নেওয়া, অচৈতন্য বাঘের নখ কেটে নেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনার সাক্ষী সুন্দরবনের বহু গ্রাম। সেই তালিকায় না ঢুকে, নজির গড়ে ফেলল ভুবনেশ্বরী গ্রাম।
এদিন ভোর বেলায় জমিতে ধান কাটতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সোনালী ধানের ক্ষেতে কালো আর হলুদে ডোরাকাটার আভাস পান তাদের কয়েকজন। চিৎকার-চেঁচামেচি করতেই বাঘ বাবাজি সেধিয়ে যায় ফসলের ক্ষেতে। ডাকা হয় পুলিশ। খবর যায় বনদপ্তরে। এরপর লোক লস্কর নিয়ে জাল, খাচা, ঘুমপাড়ানি বন্দুক, গুলি নিয়ে হাজির হন বনদপ্তর আধিকারিকরা। তাদের সঙ্গেই বন রক্ষায় গঠিত গ্রামের যুবকদের কমিটি হাত লাগায়। ততক্ষণে অবশ্য আশপাশের গ্রাম থেকে পিলপিল করে বুড়ো থেকে বাচ্চা ছুটে আসতে শুরু করেছে ভুবনেশ্বরী গ্রামে বাঘ দেখার কৌতূহলে। তখন বনদপ্তরের কাজ করাই দায় হয়ে উঠেছে। পুলিশ মাইকে ঘোষণা করতে থাকে সকলকে সরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
লোকের ভিড় আর চিৎকার-চেঁচামেচিতে দি র রয়াল বেঙ্গল টাইগার তখন বেমালুম উধাও। তারই মধ্যে কয়েকজনের চোখে পড়ে তার পায়ের ছাপ। এক ধানের জমি থেকে পাশের ধানের জমিতে তার চকিতে ঢুকে পড়া নজরে আসে। এরপর বনদপ্তর দুটি খাঁচা একটু দুরত্ব রেখে দুই দিকে বসায়। দেওয়া হয় ছাগলের টোপ। তারপরে চলতে থাকে খোঁজাখুঁজি আর অধীর অপেক্ষা। খাঁচায় বন্দী ছাগলের ডাক ছাপিয়ে তখন উৎসুক জনতার কোলাহল চারিদিকে। ফলে বাঘ এলাকায় যে ঘাপটি মেরে রয়েছে তা আন্দাজ করলেও কখন তিনি দেখা দেবেন, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলেন না বনদপ্তরের অভিজ্ঞ কর্তারা।
দিন গিয়ে সন্ধ্যে নামল। জেনারেটর চালিয়ে আলোর ব্যবস্থা হলো। সঙ্গে হ্যাজাক আর বড় বড় টর্চ জ্বালিয়ে চলতে থাকল খোঁজাখুঁজি। তখন লোকজনের ভিড় তুলনায় পাতলা হয়েছে। এরইমধ্যে দক্ষিণরায়েরও সারাদিনের ক্লান্তির পর খিদে পেয়েছিল নিশ্চয়ই। ছাগলের ডাক শুনে এসেই ঢুকে পরলেন তাকে খেয়ে ভোজ সারতে। খাঁচায় ঢুকলো বাঘ। রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা।
বনদপ্তরের কর্তারা প্রাথমিক দেখার পর বলছেন, এটি একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ। কেন সে গ্রামে ঢুকে পড়েছিল, সে ব্যাপারে অবশ্য এখনও নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা অসুস্থ নয় বলেই মনে করছেন তারা। এদিন যেভাবে গ্রামবাসীরা বাঘটিকে বাঁচাতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বনদপ্তরের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাকে বাহবা দিচ্ছেন বনকর্তারা কারণ তাদের অভিজ্ঞতা বলছে, অতীতে সুন্দরবনের লোকালয়ে ঢুকে পড়া বাঘ অনেক ক্ষেত্রেই মারা পড়েছে গণপিটুনির জন্য। কিন্তু এবারে তার ব্যতিক্রম। করে দেখালেন ভুবনেশ্বরীর বাসিন্দারা।