প্রথম পর্ব
দেশের শীর্ষ আদালতের একটি রায়ে গোটা বাংলাতেই আজ অন্ধকার নেমে এসেছে, বিপন্ন বোধ করছে রাজ্যের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ। কারণ আদালত ২০১৬ সালের এসএসসি-র গোটা প্যানেল বাতিল করায় ২৫৭৫৩ জন শিক্ষক তাঁদের চাকরি হারিয়েছেন। তার জেরে চাকরিহারাদের পরিবারগুলি যে পথে এসে দাঁড়িয়েছে সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তারপর রাজ্যের চারপাশে প্রায় প্রতিদিন যা ঘটছে তাতে রাজ্যবাসী আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর, যাদের উপর দেশগঠনেরও ভার, প্রকাশ্যে তাদের উপর পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালাচ্ছে, পেটে লাথি মারছে- বাংলার মানুষকে এমন দৃশ্যও দেখতে হল, রাজ্য সরকার ও তাদের পউলিশ বাহিনির সৌজন্যে। এই নির্মমতা কি চাকরিহারা শিক্ষকেরা প্রশ্ন তুলছেন বলে কেবল তাদের উপর আক্রোশ, নাকি শিক্ষাকেই মেরে হটিয়ে দেবার জন্য এই বর্বরতা?
একদিন আগেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইনডোরে সভা ডেকে চাকরিহারাদের আশ্বস্ত হতে বললেন, তিনি এই বলেও আশ্বাস দিয়েছেন যে যোগ্যদের চাকরি যাবে না। যদিও তাঁর কথায় মোটেও ভরসা রাখতে পারেন নি সদ্য চাকরিহারারা, কারণ তিনি যাদের সমস্যার সমাধান করবেন বলে ডেকে এনেছেন তাঁদের কোনো কথা না শুনে এক তরফা কথা বলেছেন। অন্যদিকে চাকরিহারারা ডিআই অফিসে তাদের দাবি নিয়ে অভিযান করলে পুলিশ প্রকাশ্যে লাঠি আর লাথি দিয়ে শিক্ষকদের উপর বর্বরতার জঘন্যতম নিদর্শন স্থাপন করে। অথচ মজার ব্যাপার হল এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কারিগররা, যারা চুরি-জোচ্চুরি-চিটিংবাজি এবং ঘুষের মতো অন্যায়-অপরাধের পরও কোনো শাস্তি ছাড়াই বহাল তবিয়তে আছেন। তারা শিক্ষক নিয়োগে লাগামহীন দুর্নীতি করার জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে লাভবান হয়েছেন, অথচ তাদের উপর কোনো আঘাত নেমে এল না, তারা এই বিপর্যয় থেকে অনাসায়েই রেহাই পেয়ে গেলেন। যদিবা তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই অতি স্বল্প সংখ্যককে দোষী চিহ্নিত করতে পেরেছে কিন্তু বড় অংশটাই প্রমাণ অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েও স্বচ্ছন্দেই বিরাজ করছে। তাহলে যোগ্যদের চাকরি হারা হওয়া এবং তাঁদের দুর্ভোগের দায় কাদের?
ওএমআর শিট নষ্ট করা এবং সেগুলির মিরর ইমেজ সংরক্ষণ না করার অভিযোগে বিদ্ধ এসএসসি-ও দায় নিতে নারাজ। এদিকে রাজ্য সরকার কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে টেনে আনছে। কেন বারবার বিরোধীদের দিকে আঙুল উঠছে, কেন বিজেপি, সিপিএম প্রসঙ্গ টেনে আনা হচ্ছে। এরা কেউই তো নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধারে কাছেই নেই, নিয়োগ তো করেছিল সরকার যার মাথায় মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি। অতএব ২৬ হাজার চাকরিহারা হওয়ার জন্য বিরোধিরা কেন, যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি-অন্যায়-অপরাধ এবং দুর্নীতি সব কলঙ্কের বোঝা রয়েছে রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর মাথায়৷ অথচ এই জটিল এবং ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে যাঁদের কোনও ভূমিকাই ছিল না, সেই যথার্থ মেধাসম্পন্ন শিক্ষকদের ঘাড়ে চরম শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার পরেও যখন তাদের উপর পুলিশের লাঠির আঘাত এবং শিকক্ষকদের পুলিশের মারা লাথি সহ্য করতে হয় তারপরও কারও কণ্ঠে অনুশোচনার লেশমাত্র তো দূরের কথা কেউ কেউ শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একথা অনেকদিন আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে যোগ্য শিক্ষকদের এই পরিণতির জন্য দায়ী মূলত নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই বঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন, তৃনমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার এবং তাদের দালাল চক্র। এমন নয় যে এই সাংঘাতিক ঘটনা অজান্তে বা অসাবধানতাবশত হওয়া ভুল, বরং এটি একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং সংগঠিত দুর্নীতি যার মধ্যে সরকার থেকে প্রশাসন এবং কমিশন থেকে বড়-মেজো-ছোট তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরা বেশ ভালভাবেই যুক্ত এবং এই প্রক্রিয়ায় কয়েকশ কোটি টাকা অবৈধ ভাবে লেনদেন হয়েছে। রাজ্য সরকার সেই কারণেই শুরু থেকে বিষয়টিকে চেপে দিতে এবং ঘেঁটে দিতে অতিরিক্ত তৎপরতা দেখিয়েছে, তাদের কুরুচিকর আক্রমন থেকে রেহাই পাইনি শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউই। কিন্তু কেন এসব? কারণ নিজেদের জঘন্যতম অপরাধকে ঢাকার চেষ্টা, চুরি-ঘুষকে অন্য পথে চালিত করার চেষ্টা ইত্যাদি। লক্ষ্যনীয়, শিক্ষকদের ডিআই অফিস অভিযানে সরকারের যে পুলিশবাহিনিকে আমরা লাঠি চালাতে দেখলাম, প্যান্ট-টিশার্ট এবং হেলমেট পরা এরা কারা? এদের পরিচয় নিশ্চয় কলকাতা পুলিশ নয়, তাহলে? এরা রাজ্য সরকারের ঠ্যাঙারে বাহিনি, পয়সা দিয়ে যাদের লেলিয়ে দিয়ে সরকার ন্যায্য দাবিকে দাবিয়ে দেওয়া বা দুমড়ে মুচরে দেওয়ার চেষ্টা করে।
(চলবে)