ব্রিটিশ ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে, সিমলা একসময় ঔপনিবেশিক অভিজাতদের খুব প্রিয় ছিল। তবে ব্রিটিশ যুগের জাঁকজমক আর গ্ল্যামারের আড়ালে শহরের ইতিহাসের একটি অন্ধকার দিকও রয়েছে। ভুত আর ভুতুড়ে বাড়ির গল্প বছরের পর বছর ধরে সিমলা শহরের আকর্ষণ বাড়িয়ে পর্যটকদের টেনে এনেছে। সিমলার সবচেয়ে বিখ্যাত ভুতুড়ে বাড়িগুলির মধ্যে একটি হল শার্লভিল ম্যানশন। এই পরিত্যক্ত প্রাসাদটিকে ভূতুড়ে বলা হয়। স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, বাড়িটির মালিক ভিক্টর বেইলির মারা যাওয়ার পর ভূত হয়ে যায়, তারপর থেকে তাঁকে এই প্রাসাদের হলগুলিতে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।
১৯১৩ সালে রেল বোর্ডের সহকারী সচিব পদে ব্রিটিশ সরকারের তরফে নিযুক্ত ভিক্টর বেইলি চাকরি সূত্রে সস্ত্রীক শিমলায় আসেন।শিমলায় পৌঁছনোর পর কোথায় থাকবেন তাঁরা, সেটা নিয়ে দুজনে বেশ ভাবনায় পড়েছিলেন। শেষমেস তাঁরা শিমলার ঘন জঙ্গলের মধ্যে চার্লভিলে ম্যানসন নামে একটি বিরাট বড় অট্টালিকা পছন্দ করেন এবং খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এই অট্টালিকায় আগে যিনি ভাড়া থাকতেন তিনি অলৌকিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সেই ভয়ে অট্টালিকা ছেড়ে চলে যান তিনি। এই ঘটনা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ায় আর কেউই সেই অট্টালিকায় থাকতে চাননি। তার পর থেকে জঙ্গলের ভিতর ওই বিরাট অট্টালিকার ভাড়াও কমে যায়। কম ভাড়া দিয়ে চার্লভিলে ম্যানসনের মতো এত বড় অট্টালিকায় থাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি ভিক্টর এবং তাঁর স্ত্রী। পাকাপাকি ভাবে সেখানেই থাকতে শুরু করেন তাঁরা। তবে ওই বাড়িতে থাকাকালীন নানা ধরনের কাহিনি ভিক্টরদের কানে আসতে থাকে। ভিক্টরদের আগে ওই বাড়িতে যিনি থাকতেন তিনি নাকি উপরের ঘর থেকে নানা রকম আওয়াজ শুনতে পেতেন। এক দিন বাইরে থেকে সেই ঘর বন্ধ করে দেন তিনি। পরের দিন সকালে উঠে দেখেন সেই ঘরের লন্ডভন্ড অবস্থা। অথচ ঘরের দরজা-জানলা সমস্তই আটকানো ছিল বলে দাবি করেছিলেন তিনি। এই ঘটনার পর আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকেননি তিনি। অট্টালিকা ছেড়ে চলে যান।
ওই বাড়িটি সম্পর্কে নানা রকমের ভৌতিক কাহিনি শুনলেও ভিক্টর এবং তাঁর স্ত্রী ওই ধরনের কোনও অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি। প্রথম বছর তাঁরা দু’জনে মোটামুটি শান্তিতেই বাস করেছিলেন।কিন্তু একদিন তাঁদের পরিচারিকা এক অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হন।স্থানীয়দের একাংশের দাবি, ভিক্টর তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে নৈশভোজ করতে বাইরে গিয়েছিলেন। বেইলি দম্পতির ফেরার অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের পরিচারিকা। ঠিক সেই সময় ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। হঠাৎ বাড়ির উপরের তলা থেকে নাকি শব্দ শুনতে পান ওই পরিচারিকা। সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান তিনি। একটি কালো ছায়ামূর্তিকে হাঁটাচলা করতে দেখতে পান। প্রথমে চোখের ভুল ভেবে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যান ওই পরিচারিকা। বাড়ির উপরের তলার ঘরগুলির দরজা বন্ধ ছিল বলে স্থানীয়দের একাংশের দাবি। বন্ধ দরজা ভেদ করেই নাকি কালো ছায়ামূর্তিকে ঘরের ভিতর ঢুকে যেতে দেখেন তিনি। ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মূল ফটকের বাইরে চলে যান তিনি।
ভিক্টর এবং তাঁর স্ত্রী বাড়ি ফিরলে অলৌকিক ঘটনাটির উল্লেখ করেন তাঁদের পরিচারিকা। কিছু দিন পর সেই অট্টালিকা ছেড়ে চলে যান বেইলি দম্পতি। চার্লভিলে ম্যানসনে বহু বছর আগে থাকতেন চার্লস প্র্যাট নামে ব্রিটেনের এক অফিসার। অট্টালিকার মধ্যেই নাকি আত্মহত্যা করেন চার্লস। স্থানীয়দের অধিকাংশের দাবি, চার্লসের আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায় বাড়ির ভিতর।চার্লসের মৃত্যুর পর কেউ ওই বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করলেই নাকি অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হতেন। স্থানীয়দের দাবি, ওই বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেই নাকি ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। মনে হয়, কেউ একদৃষ্টে আড়াল থেকে সব কিছু দেখছে। স্থানীয়দের কারও মতে, সেনাদের পোশাক পরা একটি ছায়ামূর্তিও নাকি বাড়ির সামনে দেখতে পেয়েছেন তাঁরা। সাধারণ জনগণের জন্য এই বাড়িতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ব্রিটেনের সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং তাঁর লেখা ‘মাই ওন ট্রু ঘোস্ট স্টোরি’ বইয়ে এই প্রাসাদের কথা উল্লেখও করেছেন।
স্থানীয়দের দাবি, ভিক্টর ছেড়ে যাওয়ার পর অট্টালিকায় এক মহিলা থাকতে শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর এক ভারতীয় পরিবারের কাছে অট্টালিকাটি বিক্রি করে দেন ওই মহিলা। বর্তমানে চার্লভিলে ম্যানসনের মালিকানা রয়েছে এক ভারতীয়ের কাছে। তিনি অট্টালিকার প্রতিটি ঘর নতুন করে সাজিয়ে তুলেছেন। তবুও এখনও নাকি এই অট্টালিকা ভূতুড়ে। বাড়িটির সামনে দিয়ে হাঁটাচলা করলে এখনও ছায়ামূর্তি দেখতে পান বলে দাবি করেছেন স্থানীয়দের একাংশ। অট্টালিকার ভিতর থেকে নাকি এখনও নানা ধরনের শব্দ ভেসে আসে। তাই সন্ধ্যার পর স্থানীয়েরা ওই বাড়ি এড়িয়ে চলেন। তবে এই ঘটনার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয়দেরই একাংশ। এ সবই লোকমুখে ছড়ানো কাহিনি বলে দাবি করেন তাঁরা