বছরের পর বছর ধরে লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন গল্পে এক অসীম ক্ষমতাশালী রানীর নাম শোনা যায়। শেবার রানী নামেই যিনি বেশী পরিচিত। বাইবেল, কোরান ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থেই রয়েছে তার উপস্থিতি। তবে তার সঠিক নাম আর রাজ্যের সীমা নিয়ে বিতর্ক চলছে শতকের পর শতক ধরে, হয়ত চলবে আরও অনেক বছর ধরে। রানীর নাম শেবার রানী। যাকে ঘিরে আছে রহস্য আর মুখরোচক গল্পের সমাহার। যদিও অনেকেই ধর্মগ্রন্থের বাইরে শেবার রানী চরিত্রটির অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দিহান। তবুও তার উপস্থিতি পাওয়া যায় তুর্কি আর পার্সিয়ান চিত্রকর্ম আর মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান চিত্রকর্মে, যাতে তিনি ধরা দেন একজন দিব্যজ্ঞানের অধিকারিণী আর ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে।
আফ্রিকা আর আরবে এখনো শেবার রানীর গল্প ছড়িয়ে আছে এবং গত তিন হাজার বছর ধরে শেবার রানীকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। শেবার রানী এবং রাজা সলোমনকে নিয়ে ইহুদী, ইসলাম আর খ্রিস্টান তিন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাই মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমান ইয়েমেনই হচ্ছে দক্ষিন আরবের রাজ্য শেবা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন শেবা নামক রাজ্যটি আসলে পূর্ব রাজ্যেটির সঠিক সীমা নিয়ে বিতর্ক আছে বহুকাল ধরে। ইথিওপিয়াই ছিল শেবা, এর পক্ষে যুক্তিদানকারীরা বলেন, শেবার রানীর রাজত্ব ছিল অ্যাকজাম নামক রাজ্যের উপর। কিন্তু রাজা সলোমনের সময়ে এমন কোনো রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, এমনকি যখন বুক অভ কিংস সম্পাদিত হয় তখনও এমন কোনো রাজ্য ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। আরবরা শেবার রানীকে বিলকিস আর ইথিওপিয়ানরা মাকেদা বলে সম্বোধন করে থাকে।
রহস্যময় নারী শেবার কথা ওল্ড টেস্টামেন্টেই সর্বপ্রথম উঠে আসে। তখনও ইহুদী, খ্রিস্টান আর ইসলাম নামক আলাদা ধর্মের সৃষ্টি হয়নি। সেখানে বলা আছে, শেবার রানী যখন জেরুজালেমের রাজা সলোমনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঈশ্বরের প্রতি তার অবিচল আস্থা এবং তার রাজ্যের প্রাচুর্যের গল্প শুনলেন তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজে উপস্থিত থেকে রাজা সলোমনের জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে সেই রাজ্যে যাবেন। শেবার রানী নিজেও অত্যাধিক জ্ঞান, সম্পদ এবং ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন রাজা সলোমনকে তিনি কঠিন প্রশ্ন করে তার জ্ঞানের পরিধীর পরীক্ষা নেবেন। সেই অনুযায়ী তিনি তার সভাসদ, ভৃত্য আর প্রচুর উপহার সামগ্রী নিয়ে জেরুজালেমের পথে রওনা দিলেন। তার কাফেলায় সোনা, মশলা, আর মূল্যবান পাথরের উপহার সামগ্রী ছিল, যা তিনি রাজা সলোমনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এতই বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমতি ছিলেন যে, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাকে রাজা সলোমনের সমকক্ষ হিসেবে তুলে ধরেছিল।
রানী ছিলেন সূর্য-পূজারী আর রাজা সলোমন একেশ্বরবাদী। অবশেষে যখন তিনি তার প্রশ্নের সঠিক আর যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেলেন তখন তিনি ঘোষণা করলেন জে তিনি নিজের জ্ঞান আর সাফল্যের যে কাহিনী শুনেছিলেন বাস্তবে তা সেই সীমা অতিক্রম করেছে। সলোমনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর ক্ষমতার প্রমাণ পেয়ে তিনি সলোমনের ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং ফিরে গিয়ে নিজের রাজ্যে মানুষের মধ্যে সেই ধর্মের প্রচার করলেন। একদা তিনি সব প্রাণীকে এক ভোজের নিমন্ত্রণ দিলেন। সমস্ত পশু-পাখি তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও বনমোরগ তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল না, কারণ ওর মতে, রাজা সলোমন আসলে সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর মহান রাজা নন, বরং শেবার রানীই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। সুতরাং রাজা সলোমন এই সম্মানের দাবীদার হতে পারেন না। এ কথা শুনে রাজা সলোমন শেবার রানীকে তার প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন তাকে সম্মান দিতে এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মেনে নিতে। এবং রানী যাতে তার ক্ষমতায় মুগ্ধ হন তার জন্য তিনি তার অনুগত এক জ্বীনকে দিয়ে শেবার রানীর পুরো রাজ্য তার রাজ্যে নিয়ে এসে রানীর সামনে উপস্থাপন করেন।
শেবার রানী একজন অসাধারণ এবং রহস্যময় ক্ষমতাধর নারী বিশ্বের মহান ধর্মীয় রচনায় অমর হয়ে আছেন, যার মধ্যে রয়েছে হিব্রু বাইবেল এবং মুসলিম কোরান। তিনি তুর্কি এবং ফার্সি চিত্রকলায়, কাবালিস্টিক গ্রন্থগুলিতে এবং মধ্যযুগীয় খ্রিস্টীয় রহস্যময় রচনাগুলিতেও উপস্থিত, যেখানে তাকে ঐশ্বরিক জ্ঞানের মূর্ত প্রতীক এবং পবিত্র ক্রুশের ধর্মের একজন ভবিষ্যদ্বাণীকারী হিসাবে দেখা হয়। আফ্রিকা এবং আরবে আজও তার গল্প বলা হয় এবং প্রকৃতপক্ষে, প্রায় তিন হাজার বছর ধরে অনেক দেশে তার গল্প বলা এবং পুনরাবৃত্ত করা হয়েছে। হলিউডও তার জাদুতে ডুবে গেছে, ১৯৫৯ সালের চকচকে সলোমন এবং শেবাতে তার গল্পের নিজস্ব পালিশ করা মহাকাব্যিক সংস্করণ প্রকাশ করেছে। তবে কিংবদন্তির উৎস এবং ইতিহাস অধরা। অন্য কোনও জনপ্রিয় নায়িকা এত বিখ্যাত কিন্তু এত বিভ্রান্তিকর নন। তিনি আসলে কে ছিলেন তা নিশ্চিত করা একটি কঠিন কাজ। যদিও শেষ পর্যন্ত, ইথিওপিয়ার রাণীর কোনও প্রাথমিক প্রমাণ, প্রত্নতাত্ত্বিক বা পাঠ্যপুস্তক নেই। আকসুমের চিত্তাকর্ষক ধ্বংসাবশেষগুলি সলোমনের সমসাময়িক কোনও রাণীর জন্য এক হাজার বছর দেরি করে – অন্তত খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীর তার ঐতিহ্যবাহী তারিখের উপর। এবং দক্ষিণ আরবের মহান সাবাই রাজ্য, যার জন্য আমাদের কাছে পাঠ্যপুস্তক প্রমাণ রয়েছে, সেই সময়ের শাসক রাজাদের নাম তালিকাভুক্ত করে যখন শেবা সিংহাসনে বসেছিলেন বলে মনে করা হয়।