এক নজরে

কলকাতা থেকে উধাও হয়ে যাওয়া চৈত্রের সঙ

By admin

April 13, 2025

বাংলা ঋতুচক্রের পালাবদলে ঘটে গ্রীষ্মের উষ্ণতায়। প্রখর তাপে মানব মন যখন তৃষিত সেই সময় বেজে ওঠে চৈত্রের বিদায় ও বৈশাখের আগমনী সুর। পুরনো কলকাতাও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই সময়ে কলকাতার বুকে ধূমধাম করেই গাজন উৎসব পালিত হত। যা আসলে একটি লোক উৎসব। এই উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবীর বিবাহ দেওয়া। গাজন উৎসবের পিছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচন্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমণ ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এই উপলক্ষ্যে পুরনো কলকাতায় তখন একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হত, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে।

উত্তর কলকাতার বিডন স্ট্রিটে যে চড়কের মেলা বসে তার আনুমানিক বয়স প্রায় আড়াইশো বছর। এই চড়ক বা গাজনের উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সঙ। কথাটির আক্ষরিক অর্থ কৌতুকাভিনেতা বা ভাঁড় হলেও, অভিধানের গণ্ডী পেরিয়ে সঙ আজকে বাঙালীর জীবনের এক ভুলতে বসা অধ্যায়। লোকনাট্য হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া সঙ বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন পুজো-পার্বণে বের করা হলেও চৈত্র মাসের গাজন উৎসবকেই সঙের উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। যেহেতু গ্রামবাংলার এই সব উৎসবের হোতা ছিল তথাকথিত প্রান্তিক সমাজ তাই এদেরই হাত ধরে সঙের প্রচলন হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই কলকাতায় সঙ যাত্রা বেরতো। সেই সময়ে কলকাতার এলাকা বা পাড়াগুলিতে বসতি গড়ে উঠেছিল একই জীবিকা বা একই জাতের মানুষের একত্রিত হওয়ার ভিত্তিতে। যেমন ডোমতলা, কুমোরটুলি, বেনিয়াটোলা, আহিরীটোলা ইত্যাদি। এইরকমই, কাঁসাপিতলের ব্যবসায়ী এবং সেই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনকে নিয়ে তৈরি হয় কাঁসারীপাড়া। পাড়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন তারকনাথ প্রামাণিক। মূলত তার এবং হিন্দু পেট্রিয়ট এর সম্পাদক কৃষ্ণদাস পালের পরিচালনায় বের হত কাঁসারীপাড়ার প্রসিদ্ধ সঙ যাত্রা, প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন। পরবর্তীকালে অবশ্য আহিরীটোলা, খিদিরপুর, বেনিয়াপুকুর, তালতলা, জেলেপাড়া প্রভৃতি এলাকা থেকেও সঙ বেরনো শুরু হয়। প্রসঙ্গত, সঙ যাত্রার গান, অভিনয়ে, ছড়াতে এমন কিছু শব্দের ব্যবহার ছিল যা অশ্লীল বলে প্রতিবাদ জানায় কলকাতার তথাকথিত ভদ্র সমাজ। পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের ঝড়ে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় সঙ মিছিলের উপর।

উল্লেখ্য, কলকাতার সঙ যাত্রা নিছকই হাস্যরস ছিল না। ছড়া, গান, অভিনয়ে প্রকাশ পেত এক ব্যতিক্রমী বার্তা। একদিকে যেমন ছিল সমাজের দুর্নীতি বা অনাচারের উপর তীব্র ব্যঙ্গাত্মক কষাঘাত, অন্যদিকে সমাজ সংস্কারকদের বৈপ্লবিক পদক্ষেপগুলির প্রতি পিছিয়ে পড়া মানুষদের না মেনে নেওয়ার প্রতিবাদ। এই ব্যতিক্রমী সঙ যাত্রাতেই অন্য মাত্রা যোগ করে জেলেপাড়ার সঙ সংস্কৃতি। জেলে বা কৈবর্তরা ছিল ধীবর প্রজাতির মানুষ, মাছ ধরাই ছিল তাদের পেশা। একটা সময়ে এই সম্প্রদায় বসবাস শুরু করে মধ্য কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলে। এলাকাটি পরিচিত হয় জেলেপাড়া নামে। ১৮৮২ সাল নাগাদ দুর্গাচরণ কুণ্ডুর আর্থিক সহায়তায় ও উদ্যোগে শুরু হয় জেলে-কৈবর্তদের সঙের মিছিল। খ্যাতনামা কবি রূপচাঁদ পক্ষী (রূপচাঁদ দাস), নাট্যকার ও অভিনেতা গোপাল উড়ে, গুরুদাস দাস, নেপালচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখেরা ছড়া-গান লিখতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে কলকাতায় প্লেগ মহামারীর আকার নিলে বন্ধ হয়ে যায় এই সঙ যাত্রা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ফের জেলেপাড়ার সঙ আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ততদিনে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ১৮৭৬ সালের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইনের নিষেধাজ্ঞায় বন্ধ হয়ে যায় কাঁসারীপাড়ার সঙ যাত্রা। কিন্তু জেলেপাড়ার সঙের পুনরাবির্ভাব ঘটে প্রতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। বাংলার লোক সংস্কৃতির অন্যতম এই অনুষঙ্গকে প্রয়োগ করা হয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে। বিশিষ্ট দেশনেতা নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের আহ্বানে এগিয়ে আসেন অমৃতলাল বসু, দাদা ঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, সজনীকান্ত দাস, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বরা।    

তবে ক্রমশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ হাতিয়ার হয়ে ওঠায় এই সঙের উৎসব তার সর্বজনগ্রাহ্যতা হারাতে শুরু করে। চটুল রঙ্গরস এবং মনোরঞ্জনের খোরাক কমে যাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে সাধারণ মানুষের একাংশ। ১৯৩০-৩১ নাগাদ আইনশৃঙ্খলা অবনতির কারণ দেখিয়ে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় এই ‘সঙ’। এরপর প্রায় পঞ্চাশ বছর কলকাতা তথা জেলেপাড়ার সঙ আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। আশির দশকে ‘কলিকাতা কৈবর্ত সমিতি’ আবার নতুন ভাবে উপস্থাপিত করে জেলেপাড়ার সঙকে। প্রতিবাদ জানানো হয় দাঙ্গা লাগিয়ে বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। ১৯৯৩ সালে ডঃ প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্রের উদ্যোগে আবার শুরু হয় জেলেপাড়ার সঙ সমিতি সঙ্ঘ, মিছিল বের করেন শঙ্কর প্রসাদ দে। বৌবাজার অঞ্চলের অক্রূর দত্ত লেন, রমানাথ কবিরাজ লেন, শশীভূষণ দে স্ট্রিট প্রভৃতি এলাকাগুলিই ছিল ১৫০ বছর আগের জেলেপাড়া যার অস্তিত্ব আজ বেঁচে আছে হয় কোনো পুরনো বাড়ীর দরজায় লেখা ঠিকানায় নয়তো দেওয়ালে আটকানো ফিকে হয়ে যাওয়া কোনো ফলকে।