কলকাতা ব্যুরো: সকলকে চমকে দিয়ে বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার পর মাস কাটার পরেই ঘরে ফিরলেন মুকুল রায়। ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত করে যখন কালীঘাটের সেই টালির বাড়িতে নিজেই একটা কিছু করার জন্য প্রবলভাবে ছটফট করছিলেন, যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি তখন তার সেই প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গ ছিলেন মুকুল রায়।
প্রতিদিনই কাঁচরাপাড়া ঘটক রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেলা সাড়ে দশটার ট্রেন ধরে তিনি পৌঁছে গেছেন, ভাঙাচোরা হরিশ চ্যাটার্জি রোডের বাড়ি। তারপর দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ চলতে চলতে কোনদিন গভীর রাত, মুকুল শেষ ট্রেনে ফিরতেন নিজের বাড়িতে। এই ভাবেই মমতার খারাপ সময়ের সঙ্গী মুকুলের হাত ধরেই সেদিন জন্ম নিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস।
তারপর সেই নদীতে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। একসময় তৃণমূল কংগ্রেস বুদির কেল্লা রক্ষার মত একটা মমতা ব্যানার্জির সাংসদ পদকে হাতিয়ার করেই রাজ্য রাজনীতিতে শিকড় গেড়ে থাকা সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারকে তুর্কি নাচন দেখিয়েছে। যেখানেই সমস্যা, যেখানেই প্রতিবাদ, সেখানেই তখন মমতা ব্যানার্জি। হাতেগোনা কয়েকজন কর্মী – নেতাকে সঙ্গে নিয়ে মমতা একাই দৌড়াচ্ছেন গোটা রাজ্য জুড়ে। সেটা ফুলবাগান হাসপাতাল একদিনে অনেক শিশুর মৃত্যু হোক বা হাওড়ায় সিপিএমের মারে যখন গৃহবধূকে বিচার পাওয়ানো। যেখানেই শাসকের বিরোধিতা তখন সেখানেই মমতা আর তার সঙ্গে প্রায় ছায়ার মত মুকুল রায়। আবার কখনো মুকুল সংগঠনের কাজে নীরবে বেশ কিছুদিন দলের কাজে ডুবে রয়েছেন, মমতা তখন আন্দোলনে।
তারপরে একে একে ভাঙ্গড় -সিঙ্গুর -নন্দীগ্রাম দীর্ঘ এক বঞ্চনার ইতিহাস। জমি আন্দোলন ছড়ালো রাজ্যে। সেখান থেকেই যেন বিরোধী নেত্রী থেকে ধীরে ধীরে শাসকে উত্তোরনের রাস্তা করে দিল মমতাকে। সেখানেও পাশে মুকুল। তবে একেবারে মমতার উল্টো বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেই। মমতা মানেই তখন উদ্বেল উদ্যম জনতা। মমতা মানে সম্মোহন। কাতারে কাতারে মানুষ ছুটছে মমতাকে দেখার, তার একটু কথা শোনার জন্য। সেই মঞ্চেই অনেকটা বাড়িতে শুভ অনুষ্ঠানে দরজায় মঙ্গল ঘটের মতো মঞ্চে সামান্য দু-একটা কথা বলা ছাড়া কোন ভূমিকাই থাকতো না মুকুলের।
বহু ক্ষেত্রে মঞ্চে কথাও বলতেন না। তার থেকেও তার কাজ ছিল যেখানে মঞ্চে মমতা আছেন, সেখানে মঞ্চের পেছনে বসে দলের সংগঠনকে মজবুত করা। কোথায় আইনি পরামর্শ নিতে হবে? কোথায় সিপিএমের মেশিনারি কি ভাবে চলে তার বুঝতে হবে, সিপিএমের ঘরে ঢুকে বের করে আনতে হবে খবর? আবার কোথাও কৌশলে তৎকালীন শাসকের ঘর থেকে বের করতে হবে কোন জরুরী কাগজ– সর্বত্রই সেই মুকুল।
একইসঙ্গে রাজ্যে বাড়তে থাকা সংগঠনকে আরো জোরালো করতে তখন মমতার ভরসা মুকুল রায়। অবশেষে ২০১১এ ক্ষমতায় এলো তৃণমূল কংগ্রেস। তখন একদিকে প্রশাসন, অন্যদিকে সংগঠন কে ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাইটার্স থেকে হেড অফিস তুলে নিয়ে গেলেন গঙ্গার ওপারে। মুকুল তখন বাইপাসের এই দলীয় অফিসের সর্বময় কর্তা। সংগঠন তখন তিনি চালাতেন এখানকার ঘরে বসেই। দীর্ঘ প্রায় সাত বছর একদিকে সংগঠন চালানো, অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসনের একটা অংশকে পরামর্শ দেওয়া এবং সব মিলিয়ে একটা সমান্তরাল নজরদারি তৃণমূলের তরফে, তখন রাখার দায়িত্ব ছিল মুকুল রায়ের উপরেই।
কিন্তু দীর্ঘ প্রায় বিশ বছরের সখ্যতা মোটামুটি দূরত্ব তৈরি হয় অভিষেক ব্যানার্জিকে তৃণমূল বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার পর। এর আগে থেকেই বিজেপি তখন সারদা ইস্যুতে রাজনৈতিক তদন্ত শুরু করে রাজ্যে। বিজেপি ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করতেই একদিকে সারদা আর অন্যদিকে নারদ মামলায় রাজ্যের শাসকদলের নেতাদের চাপ বাড়তে থাকে।
একদিকে সিবিআই বা ইডির মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সির হেনস্থার ভয়, অন্য দিকে দলের সঙ্গে মনোমালিন্য – দুয়ের জাতা কলে পরে শুরু হয় দল বদল। মুকুলের সঙ্গে তখন বেশ কিছু নেতা বিজেপিতে যান। সেখানে দিল্লির নির্দেশে তাকে সর্ব ভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলেও রাজ্যের নেতাদের কাছে তিনি ছিলেন অনেকটাই ব্রাত্য। তারপরেও ২০১৯ এ বিজেপির দুই থেকে ২৮ সাংসদ হাওয়ার পিছনে তৃণমূলের চাণক্যের ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বিধানসভা ভোটে মোদি- শাহের আক্রমণাত্মক প্রচারে বিজেপি ধরে নিয়েছিল, আর কোন কিছু ছাড়াই ক্ষমতায় চলে আসবে পদ্মফুল। ফলে মুকুলের মত দক্ষ সংগঠককে কৃষ্ণনগরের মত একটি আসনে প্রার্থী করে বেঁধে দেওয়া হয়। আর এ রাজ্যের মানুষের বিজেপি বিরোধী মানসিকতায় ৭৭ এ আটকে যায় মোদি- শাহের সব আশা।
এবার দ্বিতীয় ইনিংসে ‘ঘরের ছেলে’ র দক্ষতা কতটা বজায় আছে, তা চূড়ান্ত বোঝা যাবে তিন বছর পর। ২০২৪ সালে।