এক নজরে

প্রায় ৩৭ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিলেন যে রানী

By admin

March 21, 2022

ক্ষমতা লাভ করেই রানাভেলোনা ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি তেজস্বিনী। তার তেজোদীপ্ত ভাব বোঝাতে তিনি তাঁর রাজ্য মাদাগাস্কারের মানুষের রক্তে দেশের আবর্জনা ধুয়েছিলেন! আমৃত্যু নিরক্ষর রানী রানাভেলোনা জন্মেছিলেন দরিদ্র কৃষকের পরিবারে। যদিও তার শৈশবে মাদাগাস্কারে কোনো লিখিত ভাষার প্রচলন হয়নি। এছাড়া ইতিহাসে যেমন রানীদের রূপ ও যৌবনের গল্প শোনা যায় রানাভেলোনা ছিলেন ঠিক তার উলটো। রানাভেলোনাকে নিতান্ত বাধ্য হয়ে বিয়ে করেন রাদামা। তাদের কোনো সন্তানও ছিল না।দাম্পত্য জীবনেও রানাভেলোনা ছিলেন অসুখী। কিন্তু রাদামা রানাভেলোনাকে বিয়ের পর গুনে গুনে আরো ১১টি বিয়ে করেছিলেন! দাম্পত্য সুখ বঞ্চিত রানাভেলোনা ক্রমেই ক্ষমতালোভী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে তার ১১ সতীনের উপর নানা মানসিক অত্যাচার চালাতেন।

রানাভেলোনার ক্ষমতা লাভের পর থেকেই মাদাগাস্কারে রক্তপাত একটা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়। তিনি রাজ্যাভিষেক করেছিলেন একটি বিশাল ষাঁড়ের তাজা রক্তে হাত ধুয়ে। পরবর্তীতে কত মানুষের রক্তে যে সেই হাত রঞ্জিত হয়েছে, তারও হিসাব নেই। নৃশংসতার শুরুটা করেছিলেন নিজের পরিবার থেকেই। রাদামার ছোট ভাইকে হত্যা করে নিধন মিশন শুরু করে রানাভেলোনা ক্ষমতা লাভ করেন। তান্ত্রিকরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাজবংশের সদস্যদের রক্তপাত ঘটানো অমঙ্গল হতে পারে। রানাভেলোনা তাই রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, উপবাসে রেখে হত্যা করেছিলেন।

রানাভেলোনার ক্ষমতা দখলের সময়ে ইউরোপে উপনিবেশবাদ ডালপালা মেলতে শুরু করেছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয় উপনিবেশ বা বাণিজ্য কোনোটাই পছন্দ করতেন না। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক আরো মজবুত করতে রানাভেলোনা মাদাগাস্কার থেকে সমস্ত বিদেশীদের বিতাড়িত করেন। এমনকি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে ‘মাদাগাস্কার চুক্তি’ বাতিল করেন। এরপর মাদাগাস্কারের উপজাতীয় ঐতিহ্যবাহী ধর্ম ও সংস্কৃতিতে খ্রিস্টান মিশনারিদের খ্রিস্টধর্ম প্রচার কিছুতেই মেনে নিতে না পেরে তিনি দেশে খ্রিস্টধর্ম নিষিদ্ধ করেন এবং বহু খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করেন।

রানাভেলোনার আচরণে ক্ষুব্ধ ফরাসীরা এক সময় মাদাগাস্কারের বন্দর নগর তামাতায়ে আক্রমণ করে। রানাভেলোনার সৈন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ফারাসী বাহিনী যুদ্ধের এক পর্যায়ে শহরের ক্ষমতা প্রায় দখল করে ফেলেছিল। কিন্তু ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বহু সৈন্যের মৃত্যু ঘটলে ফরাসী বাহিনী পিছু হটে। এরপর ফরাসীরা ব্রিটিশদের সঙ্গে জোট বেঁধে মাদাগাস্কার আক্রমনে অগ্রসর হলে রানাভেলোনা সেই বিশাল বাহিনিকে ভয় দেখাতে সমুদ্রের দিকে মুখ করে কয়েকশো ইউরোপীয়-র কাটা মুন্ডু লম্বা বাঁশের আগায় গেঁথে দেন। ফরাসী-ব্রিটিশ জোট বাহিনী মাদাগাস্কারের সমুদ্রতীরে নোঙর করে বীভৎস কাটা মুন্ডু দেখে যুদ্ধে না জড়িয়ে দেশে ফিরে যায়।ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক হলেওএই ঘটনায় রানাভেলোনা তার প্রজাদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানাভেলোনার মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটতে শুরু করেছিল। প্রথমে তিনি দেশ থেকে খ্রিস্টানদের চলে যেতে বলেন এবং বিভিন্ন অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করে হত্যা করেন কিছু। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত না হয়ে তিনি হিটলারিয় পন্থায় ইহুদি নিধনের মতো খ্রিস্টান নিধন করে দশ হাজারের বেশি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ হত্যা করেন। তাঁর আক্রমণাত্মক মনোভাবে নিজের প্রজারাও তুচ্ছ কারণে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর নির্যাতনের ধরন ছিল গা শিউরে ওঠার মতো। অভিযুক্তকে দড়ি দিয়ে বেঁধে উঁচু পাহাড় থেকে ঝোলানো হত, তারপর তার পরিবারের কাউকে সেই দড়ি কাটতে বাধ্য করা হত।এছাড়াও রানাভেলোনা প্রায় হাজার খানেক মানুষকে জীবন্ত সেদ্ধ করে, পুড়িয়ে কিংবা মাটিতে পুঁতে হত্যা করেছিলেন। তাছাড়া মুন্ডুচ্ছেদ করে হত্যা ছিল সবথেকে বেশি ব্যবহৃত পদ্ধতি। এসব বর্বর পন্থার জন্যই তিনি ‘ফিমেল ক্যালিগুলা’ খেতাব পান।

রানাভেলোনার নিজের মস্তিস্কপ্রসূত নির্যাতন পন্থা ছিল বন্দীদের অমানুষিক পরিশ্রম করানো। তিনি বন্দীদের মাদাগাস্কারের বিষাক্ত সাপ আর মশা-মাছি পূর্ণ গভীর জঙ্গলে কাজে লাগাতেন যেখানে সাপের কামড়ে, ম্যালেরিয়ায় এবং খাদ্যের অভাবে কাজ করতে করতে মারা যেত। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস রানী হিসেবে পরিচিত রানাভেলোনা সৈন্যদের অনুগত্য পরীক্ষার জন্য মুরগির কাঁচা চামড়া খেতে দিতেন। কেউ তার আদেশ মানতে অস্বীকার করলে রানাভেলোনা দ্য ক্রুয়েল সেই ব্যক্তিকে ফুটন্ত গরম তেলে ছেড়ে দিতেন।