যখন তাঁর ছ’মাস বয়স আচমকা খাট থেকে পড়ে যান। তারপর জীবনের বারোটা বছর কাটাতে হয় বিছানায় প্লাস্টার বাঁধা অবস্থায়।বাড়ির বাইরে বলতে হাসপাতাল। দু দুবার অপারেশন হয়। চিকিৎসক আরও একবার অপারেশন করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। অবস্থাটা মেনে নিয়ে বাড়িতেই শুয়ে থাকতেন। জানলা থেকেরাস্তা দিয়ে দেখতেন লোকজনের চলাফেরা আর যানবাহনের যাতায়াত।
মাঝে মাঝে ইচ্ছা হত সারাদিন ঘর থেকে দেখা বাইরের দৃশ্যগুলি খাতার পাতায় তুলে ধরতে। একদিন তাই বাবার কাছে ছবি আঁকার আবদার করলেন। তাঁর বাবা কাগজ, পেন্সিল, রঙ, তুলি এনে দিলেন। শুরু হল বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছবি আঁকা।
অসুস্থতা আর স্বাভাবিক চলা ফেরার শক্তি না থাকায় বেশীরভাগ সময়ই তাঁর পায়ে থাকতো প্লাস্টার।কিন্তু ততদিনে ছবি আঁকায় দারুন উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। ছবি আঁকায় মনোযোগী ছেলেকে আরও উৎসাহ যোগাতে আঁকার তাঁর বাবা অমর নন্দন নামে একজনকে গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন। তিনিই ছিলেন তাঁর প্রথম শিল্পগুরু।
ছবি আঁকার শিক্ষণ পর্বেই পেয়েছিলেন দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী, অতুল বসু, যামিনী রায়, হুসেন, পরিতোষ সেন, বিকাশ রায়, গোপাল সান্যাল, চিত্ত দাস, আরও বহু বিখ্যাত শিল্পীর সান্নিধ্য। তাঁদের কাছেও শিক্ষালাভ করেছিলেন। কিন্তু সারাজীবন প্রথম শিল্পগুরু অমর নন্দন এর সান্নিধ্যকেই মূল্য দিয়ে গিয়েছেন।
শিল্পগুরুঅমর নন্দের সহযোগিতায় পনের বছর বয়সে আর্ট কলেজে ভর্তি হন। সেই প্রথম তাঁর বাইরের জগতের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ। প্রথমদিকে বেশ ঘাবড়েই যেতেন। পরিবেশটা যে তখনও অপরিচিত। রাস্তাঘাট, লোকজন, ব্যস্ততা,কোলাহল। তাঁর দাদা শামীম প্রথম কয়েকদিন তাঁকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন। ক্রাচে ভর দিয়ে শুরু হল যাতায়াত। তার সনহে ধরা থাকতো একটা ছোট্ট চামড়ার বাক্স ভর্তি রঙ।
প্রথমদিকে ক্লাসে ঢুকতেও ভয় পেতেন। সহপাঠী অলোকই তাঁর হাত ধরে ডেকে এনে পাশে বসাতো। সেই থেকে অলোক তাঁরসারা জীবনের সঙ্গী হয়ে যায়।কলেজ ছুটির পর অলোক তাঁকে প্রতিদিন বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতো। ক্রমে সে অলোকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাঁর বাবা-মাও অলোককে নিশ্চিন্ত মনে করতেন। অলোক একদিন তাঁর পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যায়।
আর্ট কলেজের শিক্ষা, ছবি আঁকা, তারপর ছবির প্রদর্শন। প্রথম ছবির প্রদর্শনী- সেও আর্ট কলেজের প্রথম বছরের বার্ষিক প্রদর্শনী। সেখানেই প্রথম সবাই তাঁর আঁকা ছবি দেখলো। তারপর থেকে সে প্রতি বছরই আর্ট কলেজের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। এরপর আর্ট কলেজের শেষ। পাশ করার পর কলকাতার বিভিন্ন আর্ট গ্যালারীতে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে, কখনও একক, আবার কখনও কয়েকজন শিল্পী বন্ধুর সঙ্গে।
তাঁর ছবি আঁকার কাজ শুরু হত রাত বারোটা থেকে, একটানা চলতো ভোর চারটে পর্যন্ত। কিন্তু ছবির বিষয় ভাবনা চলতো সারাদিন ধরেই। কখনো খাতায় স্কেচ করে রাখতেন। তবে ক্যানভাসে যেসব প্রকাশ ঘটতো, তা গভীর রাতে। তখন কোলাহল মুখর পৃথিবী শান্ত, মনোসংযোগে কোনও ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা নেই।
তাঁর ক্যানভাসে যা ফুটে উঠতো তা অবসাদ, যন্ত্রণা, একাকীত্বের গভীর আবেগ। জীবনের সূক্ষ আবেগগুলিতাঁর রং ও তুলি বেয়ে নেমে আসতো স্বচ্ছন্দে। তারপর ওয়াসিম কাপুরের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে উঠতো।
জীবন্ত ওইসব ক্যানভাসে বার বার ফুতে উঠেছে তাঁর প্রিয় শহর কলকাতা।আটের দশকে তাঁর তুলির রেখায় শিল্প সমালোচক মহলে সমাদৃত হয়েছিল তাঁর‘রিকশ সিরিজ’৷ রোদে পোড়া দুপুরে কলকাতার রাজপথে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাত-রিকশর সারি, এ ছাড়াও তাঁর রঙ ও রেখায় বার বার বিমূর্ত হয়ে উঠেছে কলকাতা এবং কলকাতাবাসী৷
কোনওদিন পিছু ছাড়েনি তাঁর শৈশবে একা একা বিছানায় শুয়ে থাকা জীবনের যন্ত্রণা। একটানা ১২ বছর তাঁকে একা একাই কাটাতে হয়েছে। একাকীত্বের সেই যন্ত্রণা ঘন, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন তাঁর আঁকা ছবিতে প্রায়ই ফুটে উঠত। ওয়াসিমের নিজের ভাষায়, ‘আমি তো ডিপ্রেশনকে সঙ্গে নিয়ে চলি।’