এক নজরে

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একমাত্র বাঙালি জেনারেল

By admin

January 01, 2025

খাজা ওয়াসিউদ্দিন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে একমাত্র বাঙালি সামরিক অফিসার। একটানা ১৪ বছর তিনি জেনারেল পর্যায়ে চাকরি করেছিলেন।ওয়াসিউদ্দিন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি পারিবারিক নিয়মানুযায়ী কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে বড় হন। গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে কুরআন ও ধর্মীয় আচার-আচরণ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। একই সঙ্গে ইংরেজি, উর্দু, জার্মান ও ফারসি ভাষাও অনুশীলন করেন। ঢাকা মুসলিম হাইস্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনার সময় ১১ বছর বয়সে তাকে প্রিন্স অব ওয়েলস রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি কলেজে ভর্তি করা হয় এবং এখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

এরপর তিনি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মিতে কিং কমিশনড অফিসারের জন্য আবেদন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে দেরাদুনে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষ করে আর্মির রয়েল কোর অব আর্টিলারিতে উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ২৪তম মাউন্টেন রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট খাজা ওয়াসিউদ্দিন শুরু করেন সামরিক জীবন। এই ইউনিটের সঙ্গে তিনি ওয়াজিরিস্তানসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে কাজ করে পেশাদার সামরিক অফিসার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। এরপর মেজর পদে পদোন্নতি হলে তিনি একটি মাউন্টেন ব্যাটারির দায়িত্ব পান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে যোগ দেন। জাপানি আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেজর ওয়াসি তার সৈন্যদের নিয়ে সাঁতার কেটে সিটাং নদী পার হয়ে আসেন।

এরপর তার ইউনিট ইমফলে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। একদিন একটি অভিযানের সময় জিপ নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় উঠতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনায় আহর হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে উন্নীত হন এবং ব্যাঙ্গালোরে ব্রিটিশ-ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ইন্টার সার্ভিসেস সিলেকশন বোর্ডের অ্যাডিশনাল ডেপুটি প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। দেশভাগের সময় ওয়াসিউদ্দিন সদ্যগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরের বছর তাঁকে সশস্ত্রবাহিনীর আইএসএসবি’র ডেপুটি প্রেসিডেন্ট পদ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে কর্নেল পদে পদোন্নতি হলে তিনি আইএসএসবি’র প্রেসিডেন্ট পদে নিযুক্ত হন। সেনাবাহিনীর তুখোড় মেধাবী অফিসার হিসেবে তিনি ব্রিটেনের কিম্বার্লি স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষণ নেন। দেশে ফিরে তিনি ফার্স্ট লাইট এয়ার ডিফেন্স রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এক সময় তিনি প্রাদেশিক সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন এবং দেশ ও জনগণের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ঢাকা সেনানিবাসের ভিতরে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ তার আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি তার চেয়ারম্যান হিসেবে শক্তিশালী একটি ‘বোর্ড অব গভর্নরস’ গঠন করেন, যাতে এই প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে। এরপর লাহোরে দশম ডিভিশনের জিওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে তিনি সেনাবাহিনীর বৃহত্তম সেকেন্ড কোরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে ষড়যন্ত্রের ডালপালা গজাতে থাকে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন ছিলেন তখন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ জেনারেল। কিন্তু কোর কমান্ডার পদে থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই কার্যকর হবে না বলে তাকে কমান্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো দায়িত্বই স্বাধীনভাবে পালন করার সুযোগ তাদের দেওয়া হতো না। বিপদসঙ্কুল সীমাবদ্ধ পরিবেশে শীর্ষ পর্যায়ের এই জেনারেলকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হত। জন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে তারই একসময়ের সহকর্মী ও কাছের মানুষ কর্নেল ওসমানীকে তিনি সব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর খবরাখবর জানাতেন। টের পেয়ে সরকার তাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওয়াসিউদ্দিন নিজের মর্যাদা এবং মাতৃভূমির সম্মানের কথা চিন্তা করে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান ও পদত্যাগ করলে তাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তরীণ অবস্থায় রাখা হয়।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে ‘প্রাদেশিক’ ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন তা উপেক্ষা করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেকোনো অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় তার বক্তব্য রাখতেন। এটা যে তার অসাধারণ সাহসিকতা ও দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ, তা বলাই বাহুল্য। তার বাড়ির নেমপ্লেটও ছিল বাংলা ভাষায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ওয়াসিউদ্দিন তার প্রভাব খাটিয়ে খুব দ্রুত পাকিস্তান থেকে সব বাংলাদেশী নাগরিক ও সশস্ত্র বাহিনীর সব বাঙালি সদস্যকে দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করেন। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিনকে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, তা সম্ভব হয়নি। ওয়াসিউদ্দিন সব বাংলাদেশীকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে ১৯৭৪ সালে মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনের অনেক অবদানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তিনি তার নিজ উদ্যোগে সেনাপ্রধান এরশাদকে বুঝিয়ে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার ও তাদের পরিবারবর্গের কল্যাণের জন্য ‘Retired Armed Forces Officers Welfare Association’ (RAOWA) নামের সংগঠন সৃষ্টি করেন। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।