এক নজরে

একসময়ের নিষিদ্ধ বিস্কুট পরবর্তীতে জনপ্রিয়

By admin

December 20, 2024

বিস্কুটকে মনে করা হতো ইংরেজিকরণের প্রতীক। বর্ণপ্রথা বহাল থাকায় হিন্দু সমাজে বিস্কুটকে ‘অপবিত্র’ হিসেবে মনে করা হত। সেই অবস্থার পরিবর্তন করেন লালা রাধামোহন। ১৮৯৮ সালে দিল্লিতে ‘হিন্দু বিস্কুট কোম্পানি’ চালু করেন রাধামোহন। কোম্পানির এক বিজ্ঞাপনে ঘোষণা করা হয়, উৎপাদন থেকে প্যাকেজিং সবকিছুই হয়েছে উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের হাতে। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খাওয়ার অনুভূতিই আলাদা। মিষ্টি, সল্টি, ক্রিমি কিংবা টোস্ট- যেমন বিস্কুটই হোক না কেন চা-এর সঙ্গে তা লাগবেই। কিন্তু একশো বা তার কিছু বেশি বছর আগেও ব্যাপারটা এইরকম ছিল না। তখন অনেক ভারতীয়র কাছে বিশেষ করে বর্ণপ্রথা বহাল থাকা সমাজে বিস্কুট ছিল একরকম নিষিদ্ধ খাবার।

কয়েকশো বছর আগে ভারতীয়দের কাছে বিস্কুট জাতীয় খাবার ছিল কিন্তু তা অন্য কোনো নামে বা রন্ধনপ্রণালীতে তৈরি করে খাওয়া হত। পরবর্তীকালে আরব, পারস্য এবং আরও পরে ইউরোপীয় শাসকের আগমনের ফলে বিস্কুটের স্বাদ এবং প্রস্তুত প্রণালীতে পরিবর্তন এসেছে। তবে ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে বিস্কুট এবং চা-এর মিশেলের সঙ্গে পরিচয় এবং তার আসল জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ আমলে। ‘দ্য বিস্কিট: দ্য  হিস্ট্রি অব আ ভেরি ব্রিটিশ ইনডালজেন্স’ বইয়ের লেখক খাদ্য ইতিহাসবিদ লিজি কলিহাম বলেন, গোয়া এবং পন্ডিচেরির বেকারিতে যখন পর্তুগিজ এবং ফরাসি বিভিন্ন খাদ্য তৈরি শুরু হয় তখনই ব্রিটিশদের দখলে থাকা প্রধান শহর কলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে ইংরেজদের কেক এবং বিস্কুটের প্রচলন শুরু হয়। হান্টলে অ্যান্ড পালমার্স-এর মতো কোম্পানি তখন ব্রিটেন থেকে ভারতে বিস্কুট আমদানি করতে। যদিও বিস্কুটের বাজার ছিল সীমাবদ্ধ। বিস্কুট তখন শ্রমিক শ্রেণির নাগালের বাইরে থাকা অভিজাত এক নাস্তা হিসেবে পরিচিত ছিল। আর অন্যদিকে, বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী হিন্দুদের জন্য বিস্কুট ছিল নিষিদ্ধ।

উনবিংশ শতকে একজন গোঁড়া হিন্দু বিস্কুটকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তাদের কাছে বিস্কুট ছিল ম্লেচ্ছদের খাবার। আর সামাজিক ও বিভিন্ন শ্রেণির নিয়মের কারণে অনেক হিন্দু অশুদ্ধ হিসেবে রুটি, পাখির মাংস, বরফ এবং লেমনেডের মতো বিস্কুটও খেতেন না। কেবল তাই নয়, জাত থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী, লেখক ও শিক্ষাবিদ বিপিন চন্দ্র পল তার স্মৃতিকথা ‘সত্তর বৎসর’ -এ পূর্ববঙ্গের কাছাড় জেলায় বিস্কুট নিয়ে বিশৃঙ্খলার কথা লিখেছেন। তিনি লেখেন, নতুন ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবৃত্ত শ্রেণির মানুষজন বাড়িতে চা-এর সঙ্গে বিস্কুট খায় এমন কথা সিলেট থেকে কাছাড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্কুট নিয়ে এতটাই গোঁড়ামি ছিল যে, সুরাট ও ভারুচে যেখানে ১৬২৩ সালে ব্রিটিশরা প্রথম বেকারি স্থাপন করে সেখানে উঁচু বর্ণের হিন্দুরা কাজ করত না। কারণ সেখানে তাড়ি এবং ডিম ব্যবহার হত। এগুলোকে অপবিত্র বলে মনে করা হত। তখন মুসলমান ও নিচু বর্ণের হিন্দুরা সেখানে কাজ করত। সেটাপ আবার উচ্চ জাতের হিন্দুদের বেকারি এড়িয়ে চলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ জাতপ্রথায় নিচু জাতের মানুষ থেকে খাদ্য কিংবা পানীয় গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আছে।

তবে এক সময় এসবের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহ’ ঘটে। ১৯ শতকে অনেক মানুষ পুরনো ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। তখন বিস্কুট শুইধু একটি খাদ্য নয় বরং জাতপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ব্যবহৃত পণ্যে রূপ নেয়। উদাহরণস্বরূপ, রাজনারায়ণ বসু শেরি (মদ) এবং বিস্কুট খেয়ে ব্রাহ্মসমাজে তার প্রবেশ উদযাপন করেছিলেন। এই বিদ্রোহীরা সাহসের সঙ্গে ‘নিষিদ্ধ’ ফল এবং বিস্কুট খেয়ে প্রতিবাদ করতেন। যদিও অ-হিন্দু এমনকি অ-ভারতীয় বলে তিরস্কৃত করা হত তাদের। কারণ জাতীয়তাবাদী ধারণায়, বিস্কুট ছিল ইংরেজিকরণের প্রতীক। তবে নিষিদ্ধ বিস্কুট একদিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উৎস রায় ‘কিউলিনারি কালচার অব কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’-তে লেখেন, ইউরোপীয়দের খাবারের দোকানে থাকা বিস্কুটের চাহিদা ভারতীয় মধ্যবিত্তদের মধ্যে বাড়তে থাকে। জয়িতা শর্মা ‘অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব ফুড হিস্ট্রি’ প্রবন্ধে লেখেন, তরুণরা এই লোভনীয় পণ্যের জন্য সৃজনশীল কায়াদা বের করেন। উচ্চ বর্ণের হিন্দু স্কুলছাত্ররা তাদের মুসলিম সহপাঠীদের এই ‘অবৈধ খাবার’ আনতে রাজি করাতো। ১৯ শতকের শেষের দিকে ভারতে দেশীয় বিস্কুট কারখানা গড়ে উঠছিল। মাম্বলি বাপু নামে একজন ব্যবসায়ী-যিনি বার্মা থেকে মিশরে ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে দুধ, চা এবং রুটি পাঠাতেন- ১৮৮০ সালে কেরালার থ্যালাসেরিতে রয়্যাল বিস্কুট ফ্যাক্টরি খোলেন। আর কলকাতায় ১৮৯২ সালে যাত্রা শুরু হয় ‘ব্রিটানিয়া’ বিস্কুটের।

১৮৯৮ সালে দিল্লিতে ‘হিন্দু বিস্কুট কোম্পানি’ চালু করেন রাধামোহন । দুই দশকের মধ্যে এই কোম্পানি ৫৫ ধরনের বিস্কুট তৈরি করে। ক্যান্টিন, কেবিন, ইম্পেরিয়াল, করোনেশন; এসব নামে বিস্কুটগুলোর নামকরণ হয়। কারখানায় আবার ৩০ ধরনের কেকও তৈরি হতো। রাধামোহনের পণ্য অসংখ্য পুরস্কার জিতে নেয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতার উইলসন হোটেলে পরে দ্য গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য সামরিক গ্রেডের বিস্কুটের প্রধান সরবরাহকারী হয়ে ওঠে তার কোম্পানি। সৈন্যদের কাছে সরবরাহের পাশাপাশি, হিন্দু বিস্কুট কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছিল বর্ণপ্রথা-সচেতন হিন্দুদের মধ্যে বিস্কুটকে জনপ্রিয় করা। এই লক্ষ্য অর্জনে কোম্পানি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নিয়োগ দিয়েছিল, যাতে পণ্যগুলি গোঁড়া হিন্দুদের দৃষ্টিতে পবিত্র এবং গ্রহণযোগ্য হয়।