প্রাচীন রহস্যময় একটি গুহা। আর তার ইতিহাসটাও অদ্ভুত। অনেকে বলে থাকেন, কয়েকশো বছর আগে বিরাট ভূমিকম্প হয়েছিল এই অঞ্চলে। তার থেকেই পাহাড়ের পাদদেশে এই গুহার সৃষ্টি। আবার অনেকে বলেন, পাহাড়ের ঝরনার কারণে ফাটল থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে এই গুহাটি, যা এখন আলুটিলা গুহা নামে পরিচিত। গুহাটি বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি জেলায় অবস্থিত এবং এটি প্রাকৃতিক গুহা। খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার মূল শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র সমতল থেকে ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় আলুটিলা বা আরবারি পাহাড়ে এই গুহা বা রহস্যময় সুড়ঙ্গ। স্থানীয় মানুষেরা বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। আলুটিলা খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। আলুটিলা মূলত একটি পর্বত শ্রেণী। বিশ্বে যতগুলি প্রাকৃতিক গুহা আছে আলুটিলা সুড়ঙ্গ বা গুহা তার মধ্যে অন্যতম। গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল।

লোকমুখে শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়িতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে এখানকার মানুষ এই পর্বত থেকেই বুনো আলু সংগ্রহ করে তাই খেয়ে বেঁচে থাকত। তারপর থেকে এই পর্বতটি আলুটিলা নামেই পরিচিতি লাভ করে। এখনও এখানে প্রচুর পরিমাণে বুনো আলু পাওয়া যায়। আলুটিলা গুহাটি যেখানে, সেই এলাকার আদিনাম মহাজনপাড়া। মহাজনপাড়ার ব্যবসায়ী প্রবীণ সেন ত্রিপুরা সেই সময় তাঁর কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ১৯২০ সালে প্রথম আলুটিলা গুহা আবিষ্কার করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার মূল শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্রের সমতল থেকে তিন হাজার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট আলুটিলা বা আরবারি পাহাড়ে আলুটিলা গুহা বা রহস্যময় সুড়ঙ্গটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট। গুহাটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ মিনিট। গুহাটির উচ্চতা কিছু কিছু জায়গায় বেশ কমে যাওয়ায় সেই সব জায়গা মাথা নিচু করে, এমনকি হামাগুড়ি দিয়ে পার হতে হয়।

এই গুহার ব্যাস ১৮ ফুট, ২৬৬টি সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের পাদদেশে এই গুহার মুখে পৌঁছাতে হয়। আর বের হতে হয় অন্য পথে, প্রায় ১৬০টি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে। গুহার মুখে প্রবেশের আগে মশাল জ্বালিয়ে নিতে হয়, যা প্রবেশপথেই কিনে নেওয়া যায়। আলো নিতেই হয় কারণ, এর ভেতরটা পুরোই অন্ধকার, ভেতরটা হিমশীতল ঘুটঘুটে আর পায়ের নিচে প্রবহমান ঝরনার ধারা পাথুরে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে এক অপার্থিব শব্দের সৃষ্টি করে। ঠিক যেন প্রস্তর যুগ বা প্যালিওলিথিক যুগের কোনো আদিমানবের চোখে দেবতাগুহার দর্শন। এর মধ্যে কিছুক্ষণ থাকলে একটা পুরোদস্তুর এড্রেনালিন ভাব ছুঁয়ে যায় মস্তিষ্কের নিউরনে। গুহার উপর দিক থেকে টিপটিপ করে জল পড়ে, নীচ দিয়ে বয়ে চলে ঝরনা প্রবাহ। খুব সাবধানে পা ফেলে সামনে এগতে হয় এবং সুড়ঙ্গের তলদেশ খুব পিচ্ছিল। তাই খুব সাবধানে মশাল বা আলো নিয়ে গুহা পাড়ি দিতে হয়। তবে গুহাটি কিন্তু একেবারেই নিরাপদ। দেখতে অনেকটা ভূগর্ভস্থ টানেলের মতো যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট।

গুহার ভেতরে অনেক জায়গায় জল জমে আছে, রয়েছে বড় বড় পাথর। গুহাটির উচ্চতা মাঝে মধ্যে এতটাই কম যে, হামাগুড়ি বা নতজানু হয়ে পাড়ি দিতে হয়। গুহার ভেরর প্রায় ১২-১৫ মিনিট হাঁটার পর বাইরের সূর্যের আলো চোখে পড়ে। ঠিক যেমন ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের সূর্যের রশ্মি ঘরে প্রবেশ করে তেমনি। আবার সিঁড়ি বেয়ে একটু ওপরে উঠে এলে মূল গেটের পথ পাওয়া যায়।দু’বছর আগে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র, চেঙ্গী নদীর তীরে, আলুটিলার পাহাড়-প্রকৃতির চিত্র আগে এক রকম থাকলেও এখনকার দৃশ্যপট পুরোটাই ভিন্ন। সম্পূর্ণ নতুন রূপে সাজানো হয়েছে এখানকার চারপাশ। বৌদ্ধ স্থাপত্যে গড়া দৃষ্টিনন্দন তোরণ পার হলেই দুই পাহাড় নিয়ে গড়ে ওঠা পর্যটনকেন্দ্রের শুরু থেকে গুহা সবখানে এসেছে নতুনত্ব ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০০ ফুট ওপরে আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্র। এখানকার অন্যতম আকর্ষণ এখন ঝুলন্ত ব্রিজ, দুই পাহাড়কে যুক্ত করতে তৈরি করা হয়েছে ১৮৪ ফুট দীর্ঘ লোহার এই সেতু বা কেব্‌ল ব্রিজ।

তাছাড়া চীনের পর্যটনকেন্দ্র হেনান এবং হুনান প্রদেশে কাচের তৈরি যে সেতু আছে, তারই আদলে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য সেতুতে রয়েছে কাচের বারান্দা। কাচের বারান্দা দিয়ে নীচে তাকালে পাহাড়ের অন্য রকম দৃশ্যের দেখা মেলে। মনে হবে, আপনি পাহাড়ের ওপর ভাসছেন। সেই সঙ্গে রয়েছে নন্দনকানন, রোমান কোলোসিয়ামের আদলে মঞ্চ ও ওয়াচ টাওয়ার। গুহায় একটা রোমাঞ্চকর অভিযানের পর ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে একটা প্রশান্তির নিশ্বাস নিঃসন্দেহে সব ক্লান্তি দূর করে দেবে এবং জীবনবোধে যুক্ত করবে ইতিবাচকতা।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version