অচিনপুর

আমাজন জঙ্গলের রহস্যময় জনগোষ্ঠী মাসাকো

By admin

January 06, 2025

লাতিন আমেরিকার বিশাল আমাজন জঙ্গলের গহনে বাস করে এক অন্যরকম জনগোষ্ঠী—মাসাকো। তাদের সম্পর্কে খুব কম কথাই জানা যায়, এমনকি কেন তারা ‘মাসাকো’ নামে পরিচিত, তাও এক রহস্য। আসলে মাসাকো এই অঞ্চলে বয়ে চলা একটি নদীর নাম, তবে এই নামেই কেন জনগোষ্ঠীটি নিজেদের পরিচয় দিয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। তাদের ভাষা, সামাজিকতা এবং বিশ্বাস—সবকিছু ঘিরেই যেন রহস্যের জাল। ব্রাজিল সরকারের স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরার মাধ্যমে মাসাকো জনগোষ্ঠীর কিছু ছবি সম্প্রতি ধরা পড়েছে। এই ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ব্যাপক বন কাটা, খনির কাজ, মাদক চোরাচালান এবং চাষাবাদ সত্ত্বেও মাসাকো জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বাড়ছে। ছবিগুলি ব্রাজিলিয়ান ন্যাশনাল ইনডিজেনাস পিপলস ফাউন্ডেশন (ফিউনাই) সংগঠনের মাধ্যমে পাওয়া গিয়েছে। এই সংস্থাটি দীর্ঘ দিন ধরে আমাজনের আদিবাসীদের ভূখণ্ড সুরক্ষিত রাখতে কাজ করে আসছে।

ফিউনাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০-এর দশক থেকে মাসাকোদের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ বেড়ে ২০০ থেকে ২৫০ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাজনজুড়ে যে ক্যামেরাগুলি স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে মাঝে মাঝে কিছু ধাতব যন্ত্র (যেমন প্লায়ার্স, কোদাল ইত্যাদি) ফেলে রাখা হত। এর উদ্দেশ্য ছিল, মাসাকোরা যেন এগুলির খোঁজে চাষাবাদ বা কাঠ কাটার জায়গায় না যায়, কারণ এর আগে তারা এই জায়গায় যাওয়ার পর ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল।এর আগেও ফিউনাই মাসাকোদের বসতির ছবি তুলেছিল। পরবর্তীতে স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে দেখা গিয়েছে, ওই বসতিগুলি ছেড়ে তারা চলে গিয়েছে এবং মরসুম অনুযায়ী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাদের বসতি স্থানান্তরিত হয়। মাসাকোরা তির ও ধনুক দিয়ে শিকার করে এবং বহিরাগতরা যেন তাদের এলাকায় প্রবেশ না করতে পারে, সেজন্য তারা মাটিতে ধারালো গজাল পুঁতে রাখে।

ফিউনাইয়ের কর্মকর্তা অল্টায়ার আলগেয়ার মাসাকোদের ভূখণ্ড রক্ষায় তিন দশক ধরে কাজ করছেন। তিনি জানিয়েছেন, এই নতুন ছবি বিশ্লেষণ করে আরও জানা যাবে, বলিভিয়ার গুয়াপর নদীর অপর পাশে বসবাসকারী ‘সিরিয়ন’ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মাসাকোদের কোনও সম্পর্ক আছে কি না। তবে মাসাকোদের সম্পর্কে এখনও ধারনা স্পষ্ট হয়নি, এবং অনেক কিছু এখনও রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছে। শতাব্দীজুড়ে আমাজনের বিশাল এলাকায় আদিবাসী নয় এমন মানুষরা বনভূমি দখল করছে, যা পরিবেশের ক্ষতি করছে। তবে, বিপর্যয়ের মাঝেও আমাজনের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচার পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, পেরু ও ভেনেজুয়েলা-সংলগ্ন ব্রাজিল সীমান্তে আদিবাসী জনগণের বসতি এবং চাষাবাদের ক্ষেত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, সেখানে বিরাট এলাকাজুড়ে চাষাবাদ ও আদিবাসী বসতি রয়েছে।

আরেকদিকে, যেসব আদিবাসী চাষাবাদ ও বসতি স্থাপন করে না, তারা যাযাবর জীবনযাপন করে, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির খবরও পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো পাদ্রো নদী অঞ্চলের ‘খাওয়াহিভা’ জনগোষ্ঠী। ব্রাজিলের মাতো গ্রোসে রাজ্যের আমাজন জঙ্গলে তাদের সম্পর্কে ফিউনাইয়ের কর্মকর্তা জইর কনডোর জানান, তাদের ধারণা, বর্তমানে এই জনগোষ্ঠীতে ৩৫ থেকে ৪০ জন রয়েছে। ১৯৯৯ সালে যখন তারা কাজ শুরু করেছিলেন, তখন তা ২০ জনের মতো ছিল।ব্রাজিল, বলিভিয়া, কলম্বিয়া এবং আরও সাতটি দেশের ২১টি আদিবাসী ও নাগরিক সংগঠনের যৌথ প্রতিবেদন অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকার আমাজন ও গ্রান চাকো অঞ্চলে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬১টি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে। এর বাইরে আরও ১২৮টি গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের এখনও সরকারিভাবে যাচাই করা হয়নি। এদিকে, ব্রাজিল সরকারের পক্ষ থেকে আদিবাসী জনগণের সুরক্ষার জন্য কোনও স্পষ্ট আইন গৃহীত হয়নি। এই বিষয়ে প্রতিবেদন লেখক অ্যান্টেনর ভাজ জানাচ্ছেন, পেরু ও কলম্বিয়ায় এ বিষয়ে শক্তিশালী আইন রয়েছে, তবে ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলে চাষাবাদ ও আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি চাপা পড়েছে।

আমাজন জঙ্গল নিয়ে কাজ করা ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইন দ্য আমাজনের সহপ্রতিষ্ঠাতা পাওলো মৌতিনহো বলেন, এই মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে থাকার অধিকার রয়েছে, এবং নিজেদের পছন্দমতো জীবনযাপন করার অধিকার রয়েছে। আমাজন জঙ্গল রক্ষার জন্যও বিচ্ছিন্ন এই আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে, আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির জীবনযাত্রা এবং তাদের পরিবেশ রক্ষায় সম্মান জানানো, সুরক্ষা প্রদান এবং তাদের অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখা পৃথিবীকে রক্ষায় একটি বড় ভূমিকা পালন করবে।