কথা বলা এবং গান দু’দিক থেকেই তখন ব্যাপক সাফল্য লাভ করে ‘আলম আরা’। বিশেষ করে এই ছবির গান ‘দে দে খোদা কে নাম পার’ তখনকার সময়ে দারুণ হিট হয়। আর্দেশির ইরানি ছবিতে একসঙ্গে সাতটি গান ব্যবহার করেছিলেন। ‘দে দে খোদা কে নাম পার’– এই গানটি গেয়েছিলেন ছবির অভিনেতা ওয়াজির মোহাম্মদ খান, তিনি এই ছবিতে ফকিরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই গানটি ভারতীয় ছবির প্রথম গান। পাশাপাশি ওয়াজির মোহাম্মদ খান ভারতীয় সিনেমার প্রথম প্লেব্যাক সিঙ্গার। গানটি ছবির শুটিং-এর সময় সরাসরি শুধুমাত্র একটি হারমোনিয়াম এবং তবলা বাজিয়ে টেক করা হয়েছিল।
‘আলম আরা’ ছবিতেই প্রথম শোনা গিয়েছিল মহিলা কণ্ঠে গান– ‘বদলা দিল তু সিতমগরো সে’। গানটি গেয়েছিলেন ছবির নায়িকা জুবেইদা। এই ছবিতেই শোনা গিয়েছিল ভারতীয় সিনেমার প্রথম কোরাস গান- ‘দে দিলকো আরাম অ্যায় সাকি গুলফাম’।
নব্বই বছর আগে এই উপমহাদেশে সিনেমা প্রথম কথা বলেছিল। এই ইতিহাস কম বেশি আমাদের সবারই জানা। সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রীদের মুখ থেকে কেবল সংলাপ নয়, গানও শোনা গিয়েছিল। আজ থেকে নয় দশক আগে সিনেমার এরকম ঘটনা ছিল দর্শকদের কাছে এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সিনেমা হলে। সবাক ছবিটি সেদিন এত বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল যে প্রেক্ষাগৃহের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পরবর্তী ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সিনেমা হল হাউসফুল ছিল, ওই ঘটনাও আবার আজকের যুগে কল্পনা করা কঠিন।
থিয়েটারের টুকরো-টাকরা দৃশ্য, সভাসমিতি-মিছিলের ছবি তুলে হীরালাল সেন এই উপমহাদেশে যে চলমান ছায়াছবির সূচনা করেন। সেই সূত্র ধরে ১৯১৩-তে এদেশের প্রথম কাহিনীচিত্র ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ তৈরি করে ফেলেন দাদা সাহেব ফালকে। প্রথম প্রথম কথাবার্তাহীন সেই সব ছবি দেখেই দর্শক আশ্চর্য হতেন। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে দর্শকদের মধ্যে আশ্চর্যের মাত্রা কমতে থাকে। তাছাড়া একই ধরণ নিয়ে মানুষ অনেক দিন মেতে থাকতে পারে না। অন্যদিকে ছায়াছবির ব্যবসাদাররা বুঝে ফেলেন, দর্শককে বসিয়ে রাখতে পারলে এই ব্যবসায় মুনাফা আছে। কিন্তু শব্দের অভাবেই দৃশ্যের অভিঘাত যথাযথ তৈরি করা যাচ্ছে না।
ইতিমধ্যে আমেরিকায় এলান ক্রসল্যান্ড পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ১৯২৭ সালে ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ নামে বানিয়ে ফেললেন প্রথম সবাক কাহিনীচিত্র। যাতে কেবলমাত্র সংলাপ নয়, দেখা গেল সুর ও আবহ সঙ্গীতের সমন্বিত রূপায়ণ। এর আগে ১৯২৬ সালে জন বেরিমোর নির্মিত ডন জুয়ান ছবিতে সুর ও আবহ সঙ্গীতের সমন্বিত ব্যবহার ছিল। ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ ছবিটিতে ছিল ছ’টি গান। ইংরেজি ভাষার ৮৮ মিনিটের সাদা কালো ছবিটি দেখে সিনেমা প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন আর্দেশির ইরানি।
সিনেমা পরিবশনার সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন ইরানি সিনেমা বানিজ্য যেমন বুঝে ফেলেছিলেন, তেমনি নিজের উদ্যোগে শিখে নিয়েছিলেন ছবি তৈরির কলা কৌশল। ১৯২৭ সালে আমেরিকায় প্রথম সবাক ছবি ‘দ্য জ্যাজ সিঙ্গার’ মুক্তি পাওয়ার আগেই ইরানি সাতটি নির্বাক ছবি বানিয়ে ফেলেছিলেন। এবার তাঁর ব্যবসায়ী ও শিল্পী মন চাইল টকি সিনেমার টেকনিক দিয়ে এদেশেও চমক ঘটিয়ে ইতিহাস তৈরি করতে।
তখন বিনোদনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম মঞ্চ। জোসেফ ডেভিডের ‘আলম আরা’ সেসময় বোম্বের পার্সিয়ান থিয়েটার কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দর্শকদের মুখে মুখে সেই নাটকের কথা। ইরানিকে আকর্ষন করল সেই নাটকের কাহিনি। আলম আরা আর শাহজাদা জাহাঙ্গীরের প্রেম কাহিনিকেই ইরানি বেছে নিলেন তার ইতিহাস সৃষ্টিকারী ছবির জন্য। তিনি জোসেফ ডেভিড ও মুন্সী জাহীরের হাতে চিত্রনাট্যের দায়িত্ব দিয়ে নিজে মন দিলেন সিনেমার সাউন্ড রেকর্ডিং-এ। তখন একই ফিল্মে সাউন্ড আর ছবি পাশাপাশি রেকর্ড হত। সেই মতো সাউন্ড রেকর্ডিঙের জন্য তেমন ক্যামেরা জোগাড় করতে হল। চিত্রনাট্য লেখা হল হিন্দি ও উর্দু ভাষায়। সেই ছবির জন্য শাহজাদার ভূমিকায় নির্বাচিত হলেন তখনকার বিখ্যাত স্টান্টম্যান কাম অভিনেতা মাষ্টার ভিট্টলকে; আলম আরা’র ভূমিকায় নেওয়া হল বিখ্যাত নবাব পরিবারের মেয়ে জুবেদাকে; আদিল খানের চরিত্রে নেওয়া হল পৃথ্বীরাজ কাপুরকে।
এবার শুটিং। তার আগে সুলতানের মহল বানানো হল স্টুডিয়োর ভেতর। কিন্তু ছবির শুটিং শুরু হতেই সমস্যা। প্রধান সমস্যা হল ডায়লগ টেক করতে গিয়ে। চারপাশের যত আওয়াজ- মানুষের কথাবার্তা, গাড়ির আওয়াজ, হর্ন ডায়লগের সঙ্গে মিশে শটের বারোটা বাজিয়ে দিতে লাগলো। আসলে এতদিন নির্বাক ছবিতে সাউণ্ডের কোনও বালাই ছিল না। ফিল্ম স্টুডিয়োগুলো গড়ে উঠেছিল যত্রতত্র। সাউন্ডের জন্য যে স্টুডিওগুলিতে শব্দনিয়ন্ত্রিত প্রযোজন সেটাও ভাবা হয় নি। এই প্রথম টকি, সাউন্ড ফিল্মে অবাঞ্ছিত শব্দ রেকর্ড হলে কিছুতেই বরদাস্ত করা যাবে না।
এদিকে যে স্টুডিয়োয় ‘আলম আরা’-র শুটিং সেট তৈরি হয়েছিল সেটি ছিল রেললাইনের ধারে। রেল যাতায়াতের আওয়াজে কিছুতেই সুষ্ঠুভাবে স্যুটিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। তারপর ট্রেনের সময়সুচি দেখে মাঝরাত থেকে ভোর অব্দি শ্যুটিং-এর সময় ঠিক করা হল। শব্দ ছিল এই ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট। সংলাপ ছাড়াও এ ছবির জন্য ফিরোজশাহ মিস্ত্রি আর বি ইরানি-দুজনে মিলে সাতখানা গান তৈরি করেছিলেন। তখনও সিনেমায় প্লে-ব্যাক চালু হয়নি। ফলে গানের সিকোয়েন্সে গান-নাচ সব লাইভ রেকর্ডিং হল। তারপর একদিন শেষ হল ছবি।
১৯৩১ সালের ১৪ই মার্চ মুক্তি পেল ‘আলম আরা’ বোম্বাই-এর ম্যাজেস্টিক সিনেমা হলে। এ দেশের প্রথম সিনেমা ছিল ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। সেটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯১৩ সালে। কিন্তু সেটি ছিল নির্বাক ছবি। আর্দেশির ইরানি বানিয়েছিলেন প্রথম সবাক ভারতীয় ছবি ‘আলম আরা’। হিসেব অনুযায়ী ভারতীয় সিনেমার কথা বলতে লেগেছিল প্রায় ১৮ বছর। আসলে সিনেমা তখন ক্রমশ একরকম প্রতিযোগিতা হয়ে উঠছে। সেখানে শব্দের গুরুত্ব অণুধাবন করে সমকালীন সবাক চলচ্চিত্রের থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই ‘আলম আরা’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন।