মাত্র একদিনের পার্থক্য থাকে দোল ও হোলির মধ্যে। বাঙালিরা যেদিন দোল খেলেন তার পরের দিন হোলি পালিত হয়। একই উত্সব, একই রীতি রেওয়াজ, কিন্তু আলাদা আলাদা দিনে। কেন একই উৎসব এক দিন আগে পরে উদযাপিত হয়, কেনই বা একদিন আগে পরে রঙের উৎসবকে দোল আর হোলি বলা হয়? তবে কি দোল ও হোলি উৎসব পালনের যে মূল উৎস সেটিই আলাদা? না ঠিক তা নয়, একটির কারন রাধা-কৃষ্ণের প্রেম আর অন্যটির কারন হোলিকা-র মৃত্যু। অর্থাৎ ব্যবহারিক প্রয়োগ কিংবা উৎসব আয়োজন ও পালনের আঙ্গিক এক হলেও বুৎপত্তিগত দিক থেকেই হোলি এবং দোল আদতে আলাদা আলাদা দুটি উৎসব। প্রসঙ্গত, রঙের উৎসব দোলকে বসন্তোৎসব বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ভারতীয় হিন্দু সমাজে এই দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আট থেকে আশি সকলে এই উৎসবে মেতে ওঠে। বাংলা ও ওড়িষা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন স্থানে দোল উৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়। কিন্তু ভারতের বেশির ভাগ জায়গাতেই রঙের উৎসবকে হোলি বলা হয়।

দোলযাত্রা বা দোল পূর্ণিমা পালিত হয় রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের কাহিনির ওপর ভিত্তি করে। আর হোলি পালন করা হয় নৃসিংহ অবতারের হাতে হিরণ্যকশিপু বধ হওয়ার যে পৌরাণিক কাহিনি, তার ওপর ভিত্তি করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শ্রীকৃষ্ণ এবং নৃসিংহ অবতার উভয়ই ভগবান বিষ্ণুর অবতার। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা রাতের পরের দিন দোল উত্সব পালন করা হয়। মনে করা হয় এদিনেই রাধা ও তাঁর সখীরা দল বেঁধে রং খেলায় মেতে উঠেছিলেন। সুগন্ধি ফুলের কুড়ির রং তাঁর মুখে মাখিয়ে কৃষ্ণ। সেদিনই কৃষ্ণ রাধার প্রতি তাঁর প্রেম নিবেদন করেছিলেন বলে মনে করা হয়।ভারতীয় পুরণশাস্ত্র মতে দোলযাত্রার দিনই নাকি শ্রীকৃষ্ণ রাধিকাকে ‘অফিসিয়ালি’ অর্থাৎ সরকারিভাবে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। কথিত রয়েছে এই দিনেই রাধিকাকে ‘ফাগে’ (গুড়ো রঙ) রাঙিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। উল্লেখ্য এই দিনই আবার হিন্দু বঙ্গ সমাজে পালিত হয় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার নবদ্বীপ, মায়াপুর, কৃষ্ণনগরে এই তিথি উপলক্ষে বিশেষ পুজোআর্চার আয়োজন করা হয়। বাংলার বাইরে ওড়িশাতেও ধুমধাম করে পালিত হয় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মতিথি। অসম সহ বাংলাদেশেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই দিনে রঙের উৎসবে নিজেদের সামিল করেন। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটাই বাঙালির বছরের শেষ পরব।

অন্যদিকে হোলি উৎসব হল ভগবান বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে কেন্দ্র করে যিনি রাক্ষস রাজা হিরণাকশীপুর ধর্মপ্রাণ পুত্র। দৈত্যকুলের মধ্যে রাক্ষস রাজা হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। ছেলের এই বিষ্ণু ভক্তি দেখে পিতা হিরণ্যকশিপু ছেলেকে বধ করার চেষ্টা করেন। এই কাজে হিরণ্যকশিপুকে সাহায্য করেছিলেন তার বোন হোলিকা। প্রহ্লাদকে হত্যা করার জন্য হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার প্রচেষ্টা করেন। সেই উদ্দেশে প্রহল্লাদকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন কাশ্যপ কন্যা। তবে বিষ্ণুর কৃপায় আগুন প্রহ্লাদকে স্পর্শ করতে না পারলেও সেই আগুনে পুড়ে মারা যান হোলিকা। এরপর থেকেই অশুভের উপরে শুভ শক্তির জয় উদযাপনের জন্য সারা বিশ্বে এই হোলি পালিত হয়। বাঙালি তো বটেই অবাঙালিরাও হোলি উৎসব পালনের সময় নেড়া পুড়িয়ে রঙের উৎসবের সূচনা করে। দোলের আগেও একই রকমভাবে ন্যাড়াপোড়ার আয়োজন করা হয়। বলা হয়, ওই অগ্নিস্তূপে সমস্ত অশুভর আহুতি দেওয়া হয়।
