মিশরীয় সভ্যতায় বেশ পরিচিত একটি নাম নেফারতিতি। নেফারনেফারুয়াতেন নেফারতিতি সবার কাছে মিশরের রানী এবং ফারাও আখেনাতেনের রাজকীয় বধূ হিসেবেই সুপরিচিত। নেফারতিতি ও তার স্বামী ধর্মীয় এক বিপ্লবের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তৎকালীন মিশরীয়দের মতো একাধিক দেব-দেবীর পরিবর্তে তারা একক দেবতা ‘আতেন’ বা ‘সূর্য চাকতি’র পুজো করতেন। স্বামীর সঙ্গে তিনি প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসের সবচেয়ে সম্পদশালী সময়ে রাজত্ব করতেন। ঐতিহাসিকদের মতে, স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি নেফারনেফারুয়াতেন নামে রাজত্ব করেছিলেন। মিশরের নারী ফারাও নেফারতিতির সাম্রাজ্য আমার্না শহরের পতন ঘটলে ঐতিহ্যবাহী শহর থেবসে বিস্তৃতি লাভ করে। নেফারতিতিকে বহু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। উর্বরতার রানী, মহান সৌন্দর্যের দেবী, দুই হাতের অধিকারী দেবী, প্রধান রাজার প্রিয়তমা স্ত্রী, মিশরের ঊর্ধ্ব ও নিম্নভূমির রক্ষাকর্ত্রী ইত্যাদি। তার একটি আবক্ষ মূর্তি তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। বার্লিনের ন্যুয়েস জাদুঘরে সংরক্ষিত মূর্তিটি প্রাচীন মিশরের একটি ভাস্কর্যের প্রতিলিপি। প্রকৃত ভাস্কর্যের ভাস্কর ছিলেন মিশরের অধিবাসী থুতমোস, ১৯১২ সালে তার কারখানায় খুঁজে পাওয়া যায় নেফারতিতির মূর্তিটির অস্তিত্ব। মিশরীয়দের ভাস্কর্যে মুখের প্রভাব বোঝাতে এখনো এই মূর্তিটির কথা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানো হয়।

প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রানী তিনি। থেবসের এক রাজপ্রাসাদে বড় হওয়া এই রানীর পিতা ছিলেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের উজির, অ্যাই। মাত্র এগারো বছর বয়সেই চতুর্থ আমেনহোতেপের সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কে লিপ্ত হন নেফারতিতি। কথিত আছে, আতেনের প্রতি বিশ্বাস তার মধ্য দিয়েই মিশরে প্রবেশ করে। তার পরামর্শেই চতুর্থ আমেনহোতেপ নিজের নাম পরিবর্তন করে আখেনাতেন রাখেন এবং পরবর্তীতে সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বামীর সঙ্গে রাজত্ব করলেও আখেনাতেনের মৃত্যুর পর নেফারতিতির পরিণতি কী হয়, তার কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড নেই। নেফারতিতির মায়ের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তখনকার শিলালিপিগুলোতে তার মায়ের নাম ‘তিয়ে’ লেখা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিয়ে ছিলেন নেফারতিতির দুধ মা, আসল মা নন। উজির হিসেবে অ্যাই তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিশোর চতুর্থ আমেনহোপেনের দেখাশোনাও করতেন। শৈশবেই তার রাজকুমারের সঙ্গে পরিচয় হয় নেফারতিতির। সে ও তার বোন মাদনোদজেম প্রতিদিনই থেবসের (মতান্তরে আর্মানার) সভায় হাজির হতেন।

প্রাচীন কিছু ছবি আর শিলালিপি থেকে স্পষ্ট হয়, শৈশব থেকে আতেনের অনুরক্ত ছিলেন নেফারতিতি। তবে সমসাময়িক মিশরীয়রা যেখানে একাধিক ঈশ্বরের উপাসনা করত, সেখানে তিনি একেশ্বরবাদ বা অন্যান্যদের চেয়ে আতেনকে উপরে রাখার শিক্ষা কোথা থেকে পেলেন, তা একটি রহস্য। প্রমাণ রয়েছে, নেফারতিতিরা দুই বোনই আতেনের অনুসারী ছিলেন। তাদের প্ররোচনায় চতুর্থ আমেনহোতেপ এই বিশ্বাসের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পনের বছর বয়সে চতুর্থ আমেনহোতেপের সঙ্গে নেফারতিতির বিয়ে হয়। ফারাও তৃতীয় আমেনহোতেপের মৃত্যুর পর স্বামীর সঙ্গে তিনিও সিংহাসনে আরোহণ করেন। একসময় স্ত্রীর কথামতো আমেনহোতেপের মিশরের জাতীয় ধর্মে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। তাদের রাজত্বের একটা সময় আমেনহোতেপ নিজের নাম বদলে আখেনাতেন রাখেন, মিশরের বহুকাল ধরে চলে আসা ধর্মচর্চার সংস্কৃতি বাতিল করে দেন। বাকিদের মন্দিরে তালা লাগিয়ে আতেনকে এক ও অদ্বিতীয় দেবতা হিসেবে ঘোষণা করেন। এই সিদ্ধান্তকে একদিক থেকে একেশ্বরবাদ সৃষ্টির প্রথম ধাপ বলে মনে হবে, অন্যদিকে দেবতা আমেনের পুরোহিতদের ক্ষমতা হ্রাস করার একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা বললেও ভুল বলা হবে না। আমেনহোতেপের অষ্টাদশীয় রাজরক্তের অধিকারী ছিল আখেনাতেন। এই সুদীর্ঘ সময় ধরে দেবতা আমেনের উপাসক হিসেবে তার পুরোহিতরা এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, ফারাও আর তাদেরকে সমতুল্য বলেই বিবেচনা করা হত। তবে মিশরবাসী নতুন ফারাওয়ের নতুন সিদ্ধান্তে সৃষ্টির দেবতা আতেনকে শুধুমাত্র শক্তিশালী হিসেবে না জেনে সমগ্র মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পেয়ে খুশি হয়েছিল।

আখেনাতেনের রাজত্বে নেফারতিতি অভূতপূর্ব ক্ষমতা উপভোগ করেন। তার শাসনামলে ফারাওয়ের সমান ক্ষমতা ও মর্যাদা দেওয়া হয় রানীকে। মন্দিরের দেয়ালগুলোতে ফারাওয়ের ছবি যতটা জায়গা জুড়ে থাকতো, ঠিক ততটাই বড় করে থাকতো রানীর ছবি। তার মর্যাদা সাধারণ মানুষকে বোঝানোর জন্যই হয়ত এই ব্যবস্থা করা হয়। আখেনাতেনের শবাধারের দেয়ালের চারপাশে নেফারতিতির ছবি খোদাই করা ছিল। ফারাওয়ের মমি পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সাধারণত মিশরের চার নারী দেবী: আইসিস, নেফথিস, সেলকেত আর নেইথের ছবি খোদাই করা হতো। নেফারতিতির ছবি এঁকে সেই ধারাও পরিবর্তন করে ফেলেন আখেনাতেন। আখেনাতেন ও নেফারতিতির কন্যা মেকেতাতেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে মারা যায়। সে সময়ের একটি ছবিতে দেখা যায়, মৃত সন্তানের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে তার বাবা-মা। এই ঘটনার পরপরই ঐতিহাসিক সব রেকর্ড থেকে হারিয়ে যান নেফারতিতি। বীরদর্পে রাজত্ব করতে থাকা এক রানী বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেন কীভাবে, তা আজও এক রহস্য। কেউ কেউ বলেন, মিশরে মহামারী আকার ধারণ করা প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নেফারতিতি হারিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মিশরের সিংহাসন ভাগ করে নেওয়ার জন্য অপর এক সঙ্গীর আশ্রয় নেন আখেনাতেন। সেই ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা না গেলেও, নেফারতিতিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার উদ্দেশ্যে তাকে গুম করে দিতে পারেন আখেনাতেন- এই সম্ভাবনাটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

রহস্যের জাল ছড়িয়ে পড়ে আখেনাতেনের সঙ্গীকে কেন্দ্র করে। এক তত্ত্ব মতে, নেফারতিতি নিজেই সবনেফেরু বা হাতশেপসুত নামে ছদ্মবেশ ধারণ করে মিশরের রানী হিসেবে প্রত্যাবর্তন করেন। আরেক তত্ত্ব অনুযায়ী, আখেনাতেনের উপপত্নীর পুত্র স্মেনখকারে সিংহাসনে আরোহণ করে। তার সাথে নেফারনেফারুয়াতেন নামে রাজত্ব করেন নেফারতিতি। কিন্তু নারী হিসেবেই ভিন্ন একটি ছদ্মবেশ ধারণ করার তার কী প্রয়োজন ছিল, তা বোধগম্য নয়। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস রিভস তুতানখামেনের সমাধিস্থলের ছবি স্ক্যান করিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে একটি ফাঁপা দেয়ালের সন্ধান পান। তার ধারণা, দেয়ালের অপরপাশে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে রানী নেফারতিতি। ১৯২২ সালে তুতানখামুনের সমাধিস্থল আবিষ্কৃত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার এটি।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version