টেপ রেকর্ডার বা ক্যাসেট প্লেয়ার আসার ঠিক আগের সময় সেটা। চকচকে কালো থালার মত রেকর্ডে বন্দী গান তখন। আর চারকোনা বাক্সের মত রেকর্ড প্লেয়ার। গ্রামাফোনের একটু মডিফায়েড ভার্সান। গ্রামাফোনের চোঙ জাতীয় বস্তুটি রেকর্ড প্লেয়ারে থাকত না।
উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে কম্প্যাক্ট ক্যাসেট আসার আগে পর্যন্ত গান শোনা হত মূলত রেডিওতে অথবা ‘গ্রামোফোন’-এ বড় বড় ডিস্কের ‘রেকর্ড’ চালিয়ে। ‘গ্রামোফোন’ আমেরিকান বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের ১৮৭৭ সালে উদ্ভাবিত ‘ফনোগ্রাফ’ যন্ত্রেরই উন্নততর সংস্করণ। গ্রামোফোনে অডিও শোনার জন্য শুরুর দিকে মোমের প্রলেপ দেওয়া কার্ডবোর্ড বা শক্ত মোমের ‘সিলিন্ডার রেকর্ড’ ব্যবহৃত হলেও ১৯১২ সালের মধ্যেই তা ‘শেলাক’-এর তৈরি ‘ডিস্ক রেকর্ড’-এ প্রতিস্থাপিত হয়।১৯৪০ সাল নাগাদ পলি ভাইনাইল ক্লোরাইডের বড় বড় ‘ডিস্ক রেকর্ড’ এর আবির্ভাব ঘটে। দীর্ঘ সময় জুড়ে থাকলেও এই গ্রামোফোন আর বড় বড় দামি ডিস্ক-রেকর্ডগুলো শুধুমাত্র অভিজাতদের ড্রয়িং রুমেই শোভা পেত।
প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতিতে আশির দশকের শুরুতে বাজারে আসে নতুন কমপ্যাক্ট ডিস্ক (সিডি) ও সিডি প্লেয়ার। যার জনপ্রিয়তা বা প্রসার ঘটে মূলত আশির দশকের শেষ দিকে এসে। তবে সিডির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে গান শোনার প্রধান মাধ্যম হিসেবে কম্প্যাক্ট ক্যাসেটের প্রায় ত্রিশ বছরের একচেটিয়া আধিপত্যও কিন্তু আস্তে আস্তে খর্ব হতে থাকে। এর মাঝে, ৯০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে, শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে কম্পিউটারের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে এবং প্রায় একই সময় নতুন কমপ্রেসড মিউজিক ফরমেটের (mp3 ) উদ্ভবের ফলে গান শোনার আরেকটি নতুন মাধ্যমের আবির্ভাব ঘটে।
mp3 প্লেয়ারে, বা আইপডে নিজের পছন্দের প্লে-লিস্ট অনুযায়ী অসংখ্য গান এক সঙ্গে শোনার সুবিধায় পুরনো কমপ্যাক্ট ক্যাসেটের ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমতে থাকে এবং এই মিলেনিয়ামের প্রথম দশকের মধ্যেই ক্যাসেট বা ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শোনার চল একেবারেই চলে যায়। কালের সাক্ষী হিসেবে এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ক্যাসেট প্লেয়ার টেকনোলজির বিলীন হয়ে যাওয়াটা চোখের সামনেই দেখেছি! গান শোনার একটা সুন্দর স্মৃতিময় মাধ্যমের পরিসমাপ্তি! এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকের ধারনাই নেই এই ক্যাসেট বা ক্যাসেট প্লেয়ার আসলে কী ছিল।
আমাদের বাড়িতে একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। আমার বাবার খুব শখের জিনিস। বাবার জীবনে শখ আহ্লাদ বলে কোনওদিনই তেমন কিছুই নেই। তবে এই জিনিসটা খুব শখের ছিল। বাবার মন প্রফুল্ল হলেই বাবা রেকর্ড কিনে আনতেন। রেকর্ড কিনে ফেরার পর খুব গর্বের সাথে বাবা ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে সেটা বের করে আমাদের দেখাতেন। এত খুশী হতে বাবাকে কমই দেখেছি। বাবার পছন্দ ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, খেয়াল,টপ্পা , ঠুংরী ইত্যাদি। স্বভাবতই বেগম আফতার, আঙুরবালা, ইন্দুবালা , ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গান বাবার পছন্দের তালিকায় থাকত। রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গানও বাবার খুব প্রিয় ছিল। বেশ জোরে জোরে বাজানো হত রেকর্ড গুলো। আমার একটু লজ্জাই করত কাবণ আশেপাশের কাউকে এইসব গান শুনতে দেখতাম না। খুবই ছোট তখন কিন্ত্ত বুঝতে পারতাম ।
অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, অতুলপ্রসাদী এইসব গানে রেকর্ডও কেনা হত। আধুনিক গানের সম্ভবত কোন রেকর্ড কখনো কেনা হয়নি। একবার মান্না দে র ষড় ঋতুর গান নামক একটি রেকর্ড কেনা হয়েছিল। দুই পিঠে তিনটি করে গান। এর মধ্যে ‘গহন মেঘের ছায়া ঘনায়’ গানটা আমার এত প্রিয় ছিল এখনো প্রথম বর্ষায় মেঘ করলেই আমি গেয়ে উঠি গানটা। আমার জন্মদিনে মায়ের এক প্রাক্তন ছাত্রী মহম্মদ রফির নজরুল গীতির রেকর্ড উপহার দিয়েছিল। বাবার একটুও ভাল লাগত না সেটা। বাবা যখন থাকত না তখন আমরা শুনতাম সেটা। হিন্দি গান শোনা নিষিদ্ধ ছিল আমার। কিন্ত্ত বাবা যে ক্লাসিক্যল শুনতেন বা আমি শিখতাম সেগুলোও তো হিন্দিতে! সাহস করে বলতে পারিনি কোনদিন। একবার কোনখান থেকে শুনে ‘ঝুম বরাবর ঝুম শরাবী’ গেয়ে ফেলেছিলাম। বাবা কাছাকাছির মধ্যেই ছিলেন। বাকি বৃত্তান্ত আর বলার মত না।
তখন বিভিন্ন নাটক বা নাটিকার রেকর্ড ও বের হত। সেরকমই কয়েকটি আমাদের বাড়িতেও কেনা হয়েছিল। তার মধ্যে ‘শাহজাহান ‘ ও ‘হিংসুটে দৈত্য ‘ আমার বিশেষ পছন্দের ছিল। এর মধ্যেই টেপ রেকর্ডার ও কেনা হয়ে গেছিল বাড়িতে। দুটোই চালানো হত। টেপ রেকর্ডার এ সুবিধা ছিল নিজেদের গান কথা সব রেকর্ড করে পরে নিজেরাই শুনতে পারতাম। ধীরে ধীরে রেকর্ড প্লেয়ারের কদর কমতে থাকল। রেকর্ডে ধুলো জমতে থাকল। এক সময় অবলুপ্তই হয়ে গেল।আমাদের বাড়িতে এখনো আছে সেই রেকর্ড প্লেয়ারটা। স্মৃতির সরণী বেয়ে ফিরে যাই এখনো…. অন্ধকার ছাদে বসে আছি, শিউলি ফুলের গন্ধ আসছে আর নীচ থেকে ভেসে আসছে ‘জোছনা করেছে আড়ি’…. রেকর্ড প্লেয়ার থেকে।
1 Comment
খুব সুন্দর বর্ণনা।আমার ছোটবেলা তে বাড়িতে অবশ্য একটাই গান শোনার মাধ্যম ছিল রেডিও।বন্ধুদের বাড়িতে কিংবা অন্যান্য পরিজনদের বাড়িতে অবশ্য গ্রামাফোন এ গান শুনেছি।প্রথম টেপ রেকর্ডার কিনি চাকরি পাওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরে।