কলকাতা ব্যুরো: করোনায় তখন স্তব্ধ জনজীবন। চারিদিকে চাপা আতঙ্ক। দিন আনা দিন খাওয়াদের হাহাকার। কর্মহীন মানুষ। মৎস্যজীবী তাপস বৈদ্য গিয়ে বসে থাকেন পুকুর পাড়ে। জলে নামাও তখন নিষেধ। যদি করোনা হয়। ব্যান্ডেলের সাহাগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। চোখের সামনেই জল টল টল পুকুরে কচুরি পানা ভর্তি হয়ে গেল। মাছধরা দূরস্থান। সেই পানা – পুকুর তখন নতুন মাথা ব্যাথার কারণ পেশায় মৎস্যজীবী তাপসের। সেই সময় মাথায় খেলে গেল বুদ্ধি। কোথায় যেনো শুনেছিলেন আসামে এই কচুরিপানা থেকেই তো তৈরি হয় নানান হাতের কাজ। সরকার সেখানে সাহায্য করে। তাহলে এখানে হবে না কেন! আর পুকুরের পানা তুলে কাজে যদি লাগানো যায়, তাহলে মাছ ধরার আর সমস্যা থাকবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
নানান সমাজ সংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার দরুন এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় করে ফেললেন। চিন্তাভাবনার সঙ্গেই চললো এই নিয়ে পড়াশোনা। আসাম সরকারের উৎসাহে কিছু মানুষ কচুরিপানাকে জল থেকে তুলে জলের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে দিচ্ছে। আর পানার সেই ফাঁপা কাণ্ড দিয়ে পরিবেশ উপযোগী তন্তুগুলি থেকে রূপ দিচ্ছে নানান হস্তশিল্প সামগ্রী। তিনি আরও জানতে পারেন এই Bio-degradable natural fiber -টির চাহিদা দেশে এবং বিদেশের বাজারেও বিপুল হারে আছে। কারণ এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়া ছাড়াও উদ্ভিজ বস্তু।


যেমন ভাবনা তেমন কাজ। শুরু হল নতুন পরিকল্পনা- করোনায় এলাকার কাজ হারানো মানুষদের জীবিকা ও উপার্জনের সংস্থান করতে নতুন ভাবনা। মৎস্যজীবি পরিবারের মহিলাদের নিয়ে শুরু করা হল কচুরিপানা হস্তশিল্পের উপর বিশেষজ্ঞকে দিয়ে প্রশিক্ষণ fisherman claster development-এর উদ্যেশ্যে। ইতিমধ্যেই তিনি Saamaajik Pahal Foundation নামে নিজের একটি সংস্থা তৈরি করে ফেলেছিলেন। সেখানে প্রথমে ২০ জন মহিলাকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে হুগলী জেলার পাণ্ডুয়া ব্লকে আরও ৩০ জন মহিলা নিয়ে প্রশিক্ষণ হয়। বর্তমানে আদিসপ্তগ্রামে চলছে আরও একটি প্রশিক্ষণ শিবির।


এই মহিলারা প্রশিক্ষণ চলাকালীন এবং প্রশিক্ষণের পরেও বানাচ্ছেন ব্যাগ, কস্টার, ফাইল, পেনদানী, ফুলের সাজি, গয়না, বিভিন্ন রকমের ট্রে থেকে শুরু করে রকমারি দ্রব্য। এই মহিলারাই তাদের বানানো সমস্ত দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন মেলায়। এই অভিনব হস্তশিল্প বাংলার পিছিয়ে পড়া মহিলাদের দিয়েছে অন্য এক পরিচিতি এবং কর্মসংস্থানের নতুন দিশা। তাপস বাবুর পরিকল্পনায় এখন তার এলাকায় মহিলারাই হয়ে উঠেছেন এই কাজের মূল কারিগর। যে মহিলারা এতদিন শুধু মাত্র ঘরের কাজেই নিজেদের আটকে রাখতেন, তারাও সময় বের করে যুক্ত হচ্ছেন এই কাজে। সেখান থেকে মিলছে কমবেশি আর্থিক সহায়তাও। ফলে এইসব গৃহবন্দী মহিলাদের হাতে কাজ আর কিছুটা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে তাপস বাবু হয়ে উঠেছেন তাদের কাছে এক নতুন পুরুষ। যিনি নারীকে ঘরে বন্ধ করে না রেখে, তার ক্ষমতা প্রকাশে সাহায্য করেন। নারী দিবসে তাই সেই রমণীদের সঙ্গেই তাপস বাবুর মত পুরুষেরাও নিশ্চয়ই আলাদা জায়গা করে নিতে পারেন।
শুধুমাত্র সদিচ্ছা ও সৎসাহসকে অবলম্বন করে সম্পূর্ণ নিজ পুঁজিতে যে কর্মকাণ্ড তাপসবাবু শুরু করেছিলেন, আজ তা চারিদিকে বিপুল সাড়া ফেলেছে এবং কর্মহারা মহিলারাও পেয়েছেন কর্মজীবনের নতুন দিশা।