ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত শিল্ড প্রতিযোগিতা হলেও কেবলমাত্র জাতীয় দল নয়, বিদেশি দলের অংশ নেওয়ারও রেওয়াজ ছিল। সেই রীতি অনুযায়ী ১৯৭৯-এ শিল্ড খেলতে এসেছিল উত্তর কোরিয়ার জাতীয় দল পিয়ং ইয়ং একাদশ। সে বছর শিল্ড ফাইনালে মুখোমুখি হয় পিয়ং ইয়ং আর ইস্টবেঙ্গল। আর শিল্ড ফাইনালের ওই খেলায় সুরজিৎ সেনগুপ্তের মুকুটে যোগ হয় আরও একটি পালক। এমনিতেই সেই ম্যাচে ইস্টবেঙ্গল কোরিয়ান দলটিকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল তার ওপর সুরজিৎ এমন একটি গোল করলেন তাতে কোরিয়ান দলের সবাই হতবাক হয়ে যান।

কর্ণার ফ্ল্যাগের কাছ থেকে ডেড অ্যাঙ্গেল দিয়ে সরাসরি গোল করেন সুরজিত। সবাই ভেবেছিলেন, গোল বক্সে ভেসে আসবে সুরজিতের সেন্টার। সেই মতো সাব্বির আলি অপেক্ষা করেছিলেন হেড দেওয়ার জন্য। কিন্তু সবাইকে বোকা বানিয়ে দিয়ে সুরজিতের সেন্টার এমন বাঁক নিল, বল সরাসরি ঢুকে গেল তিন কাঠির মধ্যে। সেই গোল নিয়েও শোনা যায় গল্প। ওই ম্যাচের আগের দিন নাকি ইস্টবেঙ্গলের অনুশীলন হয়নি, ক্লাবের প্রশাসনিক কিছু একটা ঝামেলায়। তাই সুরজিৎ অনুশীলন করতে চলে গিয়েছিলেন তাঁর প্রথম গুরু অচ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গুরু তাঁর প্রিয় শিষ্যকে ঠিক ওই রকম ১০০টি শট প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন ম্যাচের আগের দিন।
প্রসঙ্গত, ময়দানের ফুটবল যাদের ধ্যান জ্ঞান তাঁরাও কি আজ আর উমাকান্ত পালোধিকে মনে করতে পারেন? তবে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান ডার্বির সেই ম্যাচের কথা আজও ময়দানের ফুটবল আলোচনায় উঠে আসে। মোহনবাগানের ঘরের মাঠে লাল-হলুদের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে বিপুল ভাবে হেরেছিল সবুজ-মেরুন। ফলে লাল-হলুদের সেই জয় বিশাল মাত্রা পেয়েছিল। কিন্তু ফুটবলের মক্কা কলকাতার ময়দানে এমন ফুটবল ডার্বির গৌরবে কলঙ্কের কালি লেপন করে দিয়েছিল একটি দুর্ঘটনা। প্রিয় দলের ৫ গোলে হারের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন কট্টর মোহনবাগান সমর্থক উমাকান্ত পালোধি। সুইসাইড নোটে তিনি লিখে যান, “পরের জন্মে মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে আমি এর প্রতিশোধ নেব।” উমাশঙ্করের আত্মহুতিতে আরও একবার প্রমানিত হয় বাঙালির সেরা খেলা ফুটবল এবং বাঙালির ফুটবলপ্রেম এক ধরণের পাগলামো। কিন্তু আত্মহত্যার জন্য উমাশঙ্করকে কেউ শহিদ তকমা দেয়নি, কেউ মনে রাখেনি উমাশঙ্করকে। কেবল ওই ঘটনাই নয়,ঘরের মাঠে দলকে এভাবে সুরজিৎ সেনগুপ্তর অবিস্মরণীয় ফুটবল স্কিলের সামনে পরাস্ত হতে দেখে কার্যত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন সবুজ-মেরুণ সমর্থকরা। মাঠের মধ্যেই গ্যালারিতে এক মোহনবাগান সমর্থক হৃদরোগে আক্রান্ত হন।

এসব ঘটার পিছনে রয়েছে ঘটনাক্রম। ১৯৭৫-এর ডার্বিতে সবুজ-মেরুন বেশ কোণঠাসা ছিল। ১৯৬৯ সালে আইএফএ শিল্ডের পর কোনও ট্রফি ঢোকেনি সবুজ-মেরুন তাঁবুতে। অন্যদিকে লাল হলুদের ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫– টানা ছ’বছর কলকাতা লিগ জয় তার সঙ্গে টানা চার বার আইএফএ শিল্ড জয়ের রেকর্ড। সেই ম্যাচের প্রথমার্ধেই ৩-০ গোলে এগিয়ে যায় ইস্টবেঙ্গল। শ্যামথাপা পেনাল্টি মিস না করলে প্রথমার্ধে ব্যবধান হত ৪-০। ম্যাচের পাঁচ মিনিটেই প্রথম গোলটি করেছিলেন সুরজিত। সেই সময় চার স্ট্রাইকার নিয়ে খেলা হত। সুরজিৎ সেই লাইন আপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এমনিতেই স্ট্রাইকারের পাশাপাশি সুরজিৎ দক্ষ রাইট উইঙ্গার সঙ্গে তাঁর অসাধারণ স্কিল, সেন্টার মারার দক্ষতা ড্রিবিল করা ও চোখের নিমেষে বল পায়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল অভাবনীয়। সেদিন একইসঙ্গে সবগুলি গুণ একাকার হতেই মোহনবাগান ছারখার হয়ে যায়।

বুদ্ধিদীপ্ত উইঙ্গার সুরজিৎকে পাওয়া গিয়েছিল মারডেকা কাপে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে। মালয়েশিয়ার গোটা মাঝমাঠ এবং রক্ষণ সুরজিৎকে সামলাতে হিমসিম খেয়ে গিয়েছিল। আলাদা করে ‘টার্গেট’ করা হয়েছিল তাঁকে।পঞ্জাবের কাছে ১ গোল খেয়ে তিন গোল করিয়ে সুরজিৎ বাংলা ফুটবলের সেরা নক্ষত্র হয়েছিলেন।শেষ গোলটি এসেছিল সুরজিতের পা থেকে। গোলরক্ষক ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বল পেয়ে উইং দিয়ে দৌড় শুরু করেছিলেন সুরজিৎ। চারটে পাস খেলে গোল। পঞ্জাবের ফুটবলাররা বল ধরতে পারেননি। ওই গোলের পরেই বার ধরে ঝুলে পড়েছিলেন ‘উচ্ছ্বসিত’ সুরজিৎ।
সুরজিত উইঙ্গার বলে একটা বাড়তি গর্ব ছিল মনে। নিজেও বলেছিলেন,এক জন উইঙ্গারকে মাঠের এক দিক দেখে খেলতে হয়। তার কাছে আর একটা দিক বলে কিছু নেই। কারণ, সে দিকে সাইড লাইন। ওই খেলাটা খেলতে মগজ লাগে। আলাদা অনুশীলনের দরকার হয়। মগজাস্ত্র দিয়েফুটবাল খেলাটা সহজ নয়, তবে সে খেলা দেখে যে কারও মন ভরে যায়।
2 Comments
কলকাতার তিন প্রধান দলে খেলার আগে সুরজিত খেলতেন খিদিরপুরে। সেখানেই প্রশিক্ষক অচ্যুত বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়েছিলেন। তিনিই সেই ডেড অ্যাঙ্গেল থেকে গোল করা
শিখিয়ে ছিলেন। পিয়াং ইয়ং-এর গোলে সরাসরি বল পাঠানোর পাঠ নিয়েছিলেন সেই গুরুর কাছেই।
সত্তর আশি দশকের ফুটবল ময়দান হয়ত আজকের থেকেও অনেক বেশি উত্তাল উদ্দাম ছিল। সেদিন ময়দানে খেলতে নামত বাংলার ছেলেরা। সেই ফুটবলেরসঙ্গে জড়িয়ে থাকতো
প্র্যাকটিস, দলবদল…সেখানেও ছিল জমাট রোমাঞ্চ। এই বাতাবরণ যারা তৈরি করেছিলেন সুরজিত সেনগুপ্ত তাদের মধ্যে অবশ্যই বিশেষ নাম। হ্যাঁ তিনি হেড দিয়ে নয় মস্তিস্ক দিয়ে ফুটবল খেলতেন।