আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার নভোচারী সুনিতা উইলিয়ামস ও বুচ উইলমোর ৯ মাসের বেশি সময় পর পৃথিবীতে ফিরে প্রথমবার প্রকাশ্যে কথা বললেন। গত জুন মাসে মাত্র আট দিনের এক মিশনে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলেন দুই নভোচারী বুচ ও সুনিতা। মিশন শেষে পৃথিবীতে ফেরার কথা থাকলেও মহাকাশযানের ত্রুটির কারণে আটকে যান তাঁরা। অবশেষে গত ১৮ মার্চ তারা আমেরতিকার ফ্লোরিডা উপকূলে নেমে আসেন। এরপর গত সোমবার ৩১ মার্চ তাঁরা দুজনেই প্রথমবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। এদিন সুনিতা উইলিয়ামস বলেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে স্টারলাইনারের পরীক্ষামূলক মিশন একটি অনন্য ঘটনা। তিনি সাংবাদিকদের এও জানান, এই ঘটনা থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত। এই অভিযানে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তারা নানা কাজ শিখেছেন, প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং আশ্চর্যজনক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে আবারও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যেতে চান তিনি।
সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের উত্তরে সুনিতা উইলিয়ামস বলেন, ‘আমরা ফিরেই আসতাম, শেষমেশ আমরা ফিরেও এসেছি। এখন আমাদের এই ঘটনা সবাইকে জানাতে হবে…কারণ, এটি একটি অনন্য ঘটনা। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে’। সুনিতা স্বীকার করেছেন, স্টারলাইনারের পরীক্ষামূলক মিশনে যে আলাদা কিছু একটা হবে, তা তাঁরা জানতেন। কিন্তু তাঁদের বিষয়ে মানুষের এত প্রত্যাশা থাকবে, মানুষ এত মনোযোগ দেবে, তা তাঁরা কেউই সেটা ভাবতে পারেননি। এই যাত্রায় সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও উত্তেজনা দেখে তিনি ও বুচ উইলমোর অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছেন। বুচ বলেছেন, ‘আমরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, সেগুলো ঠিক করে ফেলব। এটাকে আবার কার্যকর করে তুলব। বোয়িং ও নাসা সম্পূর্ণরূপে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাব।’
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকাকালে রাজনীতির প্রভাব সম্পর্কে বারবার সুনিতা ও উইলমোরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে নিক হেগ বলেছেন, ‘যখন আমরা মহাকাশে কাজ করি, তখন রাজনীতির কোনো কিছুই অনুভব করি না’। অবশেষে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে গত ১৪ মার্চ আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে ‘ক্রু-১০’নামে একটি মিশন পাঠায় নাসা ও ধনকুবের ইলন মাস্কের মহাকাশ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। এই মিশনে ছিলেন নাসার নভোচারী অ্যান ম্যাকক্লেইন, নিকোল আয়েরস, জাপান মহাকাশ অনুসন্ধান সংস্থা জেএএক্সএর নভোচারী তাকুইয়া ওনিশি ও রুশ মহাকাশ সংস্থা রসকসমসের নভোচারী কিরিল পেসকভ। ‘নাসা ক্রু–৯ মিশন’–এর অংশ হিসেবে ক্রু ড্রাগনে ফিরতি যাত্রা শুরু করার ১৭ ঘণ্টা পর এই চার নভোচারী পৃথিবীর আকাশমণ্ডলে প্রবেশ করেন। ভারতীয় সময় ১৮ মার্চ রাত প্রায় ৩টে নাগাদ তাঁদের বহনকারী ক্যাপসুলটি বিশেষ প্যারাস্যুটের সাহায্যে আমেরিকার ফ্লোরিডা উপকূল থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে সমুদ্রে নেমে আসে।
মহাকাশ থেকে কেমন দেখাচ্ছিল ভারতকে সাংবাদিকদের করা এই প্রশ্নের উত্তরে সুনীতার সহাস্য জবাব, “মহাকাশ থেকে ভারতকে খুবই সুন্দর দেখায়।” সেইসঙ্গে তিনি আরও জানান, তাঁদের মহাকাশযান থেকে হিমালয় দেখা গিয়েছে কয়েকবার। প্রতিবারই হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য মুগ্ধ করেছে তাঁকে। হিমালয়ের সৌন্দর্য নজরকাড়া এবং মন ছুঁয়ে যাওয়া।” ভারতকে অপূর্ব দেশ বলে সম্বোধন করেন সুনীতা। জানান, পৃথিবীর বুকে এই দেশ গণতন্ত্রের এক অন্যতম নিদর্শন। ভারতের সঙ্গে তাঁর গভীর আত্মিক যোগ রয়েছে৷ কারণ তাঁর বাবা ছিলেন একজন ভারতীয়। সুনীতা শুধু ভারত নয়, মুম্বই ও গুজরাতের দৃশ্যের কথাও উল্লেখ করেন৷ তিনি বলেন, “এই শহরগুলিকে দেখে মনে হয় যেন আগাগোড়া আলোকমালায় মোড়া৷ যা এককথায় অপরূপ। তাঁর আরও মনে হয় বড় শহর থেকে ছোট শহরে এই আলো ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয় সভ্যতা এবং আধুনিকতার এক অপূর্ব মিশেল রচনা করে”। ভারতের ভৌগলিক সীমানার কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, পশ্চিমে গুজরাত ও মুম্বইয়ের উপকূলের মাছ ধরার নৌবহর থেকে শুরু করে উত্তরের বিশাল হিমালয়৷ স্পেস স্টেশন থেকে তাকিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছে নিজের শিকড়ের কথা।
সুনীতা আরও বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে আমি আমার বাবার জন্মভূমিতে ফিরে যাব।’ বাবার জন্মভূমি সম্পর্কে উচ্চারিত এই কয়েকটি কথা থেকে স্পষ্ট তিনি আমেরিকার নাগরিক হলেও শিকড়ের টান আজও আছে তাঁর রক্তে৷ ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাসার মহাকাশচারী সুনিতা উইলিয়ামসের বাবা দীপক পান্ড্য গুজরাতের ঝুলাসন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ১৯৫৭ সাল থেকে আমেরিকায় বসবাস শুরু করেন। সুনিতার জন্ম হয়েছিল ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ সালে ওহাইওতে দীপক পান্ড্য এবং স্লোভেনীয়-আমেরিকান উরসুলিন বনির ঘরে। সাংবাদিক সম্মেলনে সুনীতা বলেন, “আমি পৃথিবীতে ফিরে আসতে পেরে খুশি। আমরা বর্তমানে পুনর্বাসন কেন্দ্রে আছি। নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপাতত বাড়ি ফিরে পরিবারের সদস্যদের কাছে পেতে চাই”।