দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান। ৯ মাস মহাকাশে কাটিয়ে অবশেষে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নভোচারী সুনীতা উইলিয়ামস ও তাঁর সহযাত্রী বুচ উইলমোর। ভারতীয় সময় বুধবার ভোর ৩ টে ২৭ মিনিটে তাঁদের মহাকাশযান স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুল ফ্লোরিডা উপকূলে সমুদ্রে অবতরণ করে। তাঁদের সঙ্গে ফিরেছেন নাসার নিক হগ ও রুশ নভোচারী আলেকজান্ডার গর্বুনভ। ২০২৪ সালের ৫ জুন বোয়িং স্টারলাইনার মহাকাশযানে করে মাত্র ৮ দিনের জন্য আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (ISS) পাঠানো হয়েছিল সুনীতাদের। কিন্তু মহাকাশযানে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় তাঁদের প্রত্যাবর্তন দীর্ঘ ৯ মাস পিছিয়ে যায়। অবশেষে নাসা ও স্পেসএক্সের যৌথ উদ্যোগে তাঁদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়।

FILE – NASA astronauts Suni Williams, left, and Butch Wilmore stand together for a photo enroute to the launch pad at Space Launch Complex 41 Wednesday, June 5, 2024, in Cape Canaveral, Fla., for their liftoff on a Boeing Starliner capsule to the International Space Station. (AP Photo/Chris O’Meara, File)

মঙ্গলবার ভারতীয় সময় সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলে যাত্রা শুরু করে সুনীতারা দীর্ঘ ১৭ ঘণ্টার সফর শেষে বুধবার ভোরে ফ্লোরিডা উপকূলের সমুদ্রে নিরাপদে অবতরণ করে ক্যাপসুলটি। তাঁদের উদ্ধারে প্রস্তুত ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ ও উদ্ধারকারী দল। ক্যাপসুলের দরজা খুলতেই প্রথম বেরিয়ে আসেন নিক হগ, আর ৫ মিনিট পর হাসিমুখে দেখা যায় সুনীতা উইলিয়ামসকে। এই ৯ মাস মহাকাশ স্টেশনে থেকে সুনীতারা ১৫০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পন্ন করেছেন, যার মধ্যে ছিল মহাকর্ষের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। স্পেসওয়াক করেছেন প্রায় ৬২ ঘণ্টা, যা তাঁকে মহাকাশে সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো নারীদের একজন করেছে।

গত বছর জুন মাসে Boeing Starliner মহাকাশযানে চেপে অভিযানে গিয়েছিলেন সুনীতা ও ব্যারি। অভিযান আট দিন চলার কথা ছিল। কিন্তু তার পর থেকে নয় নয় করে সাড়ে ন’মাস কেটে যায়। মহাকাশযানটি বিকল হওয়ায় মহাকাশে আটকে পড়েন সুনীতারা। পরে মহাকাশযানটিকে সারিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আনা হলেও, ওই যানে সুনীতাদের ফেরোনার ঝুঁকি নেয়নি NASA. বরং ইলন মাস্কের সংস্থা SpaceX-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার পরও বার বার পিছিয়ে যায় সুনীতাদের ফেরানোর অভিযানে। তবে শেষ পর্যন্ত নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে এলেন সুনীতারা। তাঁদের ফেরা নিয়ে কার্যত প্রহর গুনছিল গোটা পৃথিবী। তিনি নিরাপদে ফিরে আসায় ভারতেও খুশির আমেজ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একদিন আগেই সুনীতাকে নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, সুনীতাকে চিঠি লিখেছেন তিনি। মহাকাশযানে সুনীতার অনন্যকীর্তিতে ভারত যে গর্ববোধ করছে, তাও জানান। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনীতার প্রত্যাবর্তনে খুশির হাওয়া সর্বত্র। গুজরাতে আতসবাজি ফাটিয়ে সুনীতার প্রত্যাবর্তন উদযাপনের ছবি ও ভিডিও সামনে এসেছে। সুনীতাদের এই অভিযান আগামীতে মহাকাশ গবেষণার পথ আরও প্রশস্ত করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। 

সুনীতাদের মহাকাশ পাড়ির পর ছিল লাগাতার সমস্যা। ৫ জুন সুনীতাদের নিয়ে উড়ে গিয়েছিল স্টাইলাইনার। প্রপালশন সিস্টেম সংক্রান্ত বিষয় এবং হিলিয়াম লিকের কারণে একাধিকবার দেরি হওয়ার পরে অবশেষে মহাকাশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। ৬ জুন থেকে ২৫ জুন ২৭ ঘণ্টার যাত্রার পরে মহাকাশে পৌঁছে গিয়েছিলেন সুনীতারা। আটদিনের মতো থাকার কথা ছিল তাঁদের। কিন্তু প্রপালশন সিস্টেমে গোলযোগ এবং হিলিয়াম লিকের কারণে ১১ জুন সুনীতাদের ফেরার সময় পিছিয়ে দিয়েছিল নাসা। ২১ জুন ফের পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ জুন যখন তৃতীয়বার সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার সময় পিছিয়ে দিয়েছিল নাসা, তখন স্টারলাইনারকে নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। এরপর ২১ জুলাই আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে ৪৫ দিন কাটিয়ে ফেলেছিলেন সুনীতা এবং বুচ। অর্থাৎ স্টারলাইনারকে সর্বোচ্চ যতদিন থাকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, সেটা ছুঁয়ে ফেলেছিল। কিন্তু তখনও নাসা এবং বোয়িং নিশ্চিত ছিল না যে কবে মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে ফিরতে পারবেন। চালানো হচ্ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা

২৪ অগস্ট ইলন মাস্কের স্পেসএক্স ড্রাগন মহাকাশযানে করে সুনীতাদের পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। যা সেপ্টেম্বরে পৃথিবী থেকে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। যে মহাকাশযানের ফেরার কথা ছিল ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ৬ সেপ্টেম্বর সুরক্ষিতভাবে নিউ মেক্সিকোয় অবতরণ করেছিল সুনীতাদের মহাকাশে নিয়ে যাওয়া স্টারলাইনার। তবে ফেরার সময় সুনীতারা ছিলেন না। কারণ মহাকাশচারীদের নিয়ে ফেরার সময় যে সুরক্ষা প্রোটোকলের প্রয়োজন হয়, সেটা পায়নি স্টারলাইনার। ২৯ সেপ্টেম্বর দুই মহাকাশচারীকে নিয়ে উড়ে গিয়েছিল নাসার ক্রিউ-৯ মিশন। তাতে চারজন মহাকাশচারীর জায়গা ছিল। কিন্তু সুনীতা এবং বুচকে ফিরিয়ে আনার জন্য দুটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছিল। কথা ছিল যে ক্রিউ-১০ মিশন গেলে সুনীতারা ক্রিউ-৯ মহাকাশযান চেপে ফিরে আসবেন।

১৭ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি ক্রিউ-১০ মিশনের উৎক্ষেপণ পিছিয়ে দিয়েছিল নাসা। সেটি মহাকাশে গেলে তবে পৃথিবীতে ফিরতে পারতেন সুনীতারা। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর জানানো হয়েছিল যে মহাকাশে যাওয়ার জন্য যে ক্রিউ ক্যাপসুলের প্রয়োজন আছে, সেটার উৎপাদনে স্পেসএক্সের দেরি হয়েছে। ফলে মার্চে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। তারইমধ্যে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক কারণে এত জট তৈরি হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছিল। এরপর ১২ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ ক্রিউ-১০ মিশনের রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লঞ্চপ্যাডে সমস্যার জন্য দু’দিন পিছিয়ে গিয়েছিল। তারপর ১৪ মার্চ উৎক্ষেপণ করা হয়। ১৬ মার্চ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রে পৌঁছায় ক্রিউ-১০ মিশন। ১৮ মার্চ, রাত ১ টা ৫ মিনিটে (ফ্লোরিডার সময়) আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় স্পেসএক্স ক্রিউ-৯ মহাকাশযান। শুরু হয় পৃথিবীতে ফেরার ১৭ ঘণ্টার মিশন। তাতে সুনীতা, বুচ-সহ মোট চারজন আছেন। মঙ্গলবার বিকেলে ফ্লোরিডা উপকূলে অবতরণ করল।  

পৃথিবীতে ফিরলেও এখনই পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না তাঁরা। কয়েক সপ্তাহ তাঁদের রাখা হবে বিশেষ ক্রু কোয়ার্টারে, যেখানে চলবে শারীরিক পরীক্ষার পর্ব। মহাকাশে দীর্ঘদিন থাকার ফলে ভারসাম্য হারানো, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া এবং পেশির শক্তি হ্রাসের মতো সমস্যার সম্মুখীন হন নভোচারীরা। তাই তাঁদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। এই সফল প্রত্যাবর্তন নাসা, স্পেসএক্স এবং বোয়িং-এর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানকে আরও উন্নত ও নিরাপদ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version