ইন্দ্রনীল বসু
অন্নদাশঙ্কর রায় বলতেন, বয়স বাড়ছে , জীবন ঠিক কমছে না। শেষ জীবনের ঘটনার কথা। সাক্ষাৎকারে এই কথাই বলতেন অন্নদাশঙ্কর। সুনীল একই কথা একটু অন্যভাবে তাঁর জন্মদিনের সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন। জন্মদিনের সময়টা বা দিনটি তার কাছে শেষ জীবনে বেশ অস্বস্তিকর ছিল। মনে হতো বয়সের কথা তাঁকে জোর করে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বয়স বাড়ছে টের পেতেন না বোধ হয়। এতই জীবনীশক্তি ছিল ? বলতেন না অনেক কিছুই করতে পারেন না যেগুলি আগে করতেন। কিন্তু হয়ত বয়স এর ব্যাপারটা মনে রাখতে চাইতেন না। এত বয়সে নীরার হয়ত পাত্তা পাবেন না মনে করতেন ।
ভালোবাসা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে শেষ জীবনেও তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। আর বলা বাহুল্য সেই ভালোবাসা ছিলো নীরার প্রতিই । কবিতা খুব একটা আসতো না সুনীলের শেষের দিনগুলিতে। কিন্তু কখনো কখনো নীরার দেখা পেতেন ঘুমের মধ্যে। একটা লাইন বা দুটো লাইন মনে পরে যেত রাতের অন্ধকারে। উঠে লাইট জ্বেলে লিখে রাখতেন লাইনগুলো। ৭৫ তম জন্মদিন থেকে বয়স বাড়ার অনুভবটা আস্তে আস্তে আসতে শুরু করে। রাগ কারো ওপর পুষে রাখতেন না। বলতেন এতে নিজেরই খারাপ হয়। ভেতরটা ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে বলে মনে হয়। তাই ” অর্ধেক জীবন” এ কোনো মনোমালিন্যের কথা নেই। নেই কোনো খারাপ অভিজ্ঞতার কোথাও। শেষ জীবনে ওই সব কিছু মনে রাখতে চাইতেন না সুনীল। তাই কোনো প্রতিক্রিয়াও দিতেন না সহজে। বলতেন রবীন্দ্রনাথ আদর্শ।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে এত দ্বন্দ্ব ছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু কোনদিন দ্বিজেন্দ্রলালের বিরুদ্ধে কোনো খারাপ মন্তব্য করেননি রবীন্দ্রনাথ। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটাই শেষ জীবনে বোধয় প্রধান হয়ে ওঠে। আর সেটা নিয়েই ভাবতেন সুনীল নিরলস। ভালোবাসা নিয়ে এবং দিয়ে যাবেন। এটাই শেষ জীবনে সুনীল গাঙ্গুলির প্রধান ভাবনা হয়ে উঠেছিল। খুন , জখম , মারপিট, বৈরিতা সহ্য হতো না একেবারেই।
দস্টয়ভেস্কি, কাফকা, মানিক বন্দোপাধ্যায় প্রিয় লেখক ছিলেন বরাবর সুনীল বন্দোপাধ্যায়ের। ভালো লাগতো তাদের পড়তে। কিন্তু অনুকরণ করেননি কোনোদিন। প্রিয় লেখক হলেও তাদের কারো কারো দুর্বোধ্য লেখার ব্যাপারটি আবার অনেক ক্ষেত্রে ভালো লাগতো না। লেখা হবে সহজ, সরল সাদাসিধে এটাই বলে ও করে গেছেন সারা জীবন। লেখার আগে নিজে উচ্চারণ করে নিতেন। দেখতেন সুন্দর আর শ্রুতিমধুর লাগছে কি না। নিজেই নিজেকে শাসন করতেন। মদ্যপান কমিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটা। কিন্তু সিগারেট প্রত্যেকদিন ছাড়বো মনে করেও পারেননি। একটা অতৃপ্তি যা সব শিল্পীর থাকে সেটা থেকেই গিয়েছিল। লাইটহাউস এর স্বপ্ন আসত মাঝে মাঝে। কিন্তু পৌঁছতে পারেন নি কোনোদিন। স্পর্শ করা হয়ে ওঠেনি।