সেদিন বিকেল বেলায় ভিজিটিং আওয়ারে নানুকাকা তাঁকে দেখতে এলেন। সেদিনই সকাল বেলায় ছেলেটা জন্মেছে। সত্তর বছর আগের ঘটনা। সদ্যোজাত ছেলেটাকে নানুকাকা কোলে তুলে নিয়ে লক্ষ্য করলেন ছেলেটার বাঁ কানের উপরের দিকে একটি খুব ছোট্ট ফুটো রয়েছে। নানুকাকা কাউকে আর সে কথা বললেন না। নানুকাকা আবার পরেরদিন সকালবেলা ছেলেটাকে দেখতে এলেন। আবার তাঁর মায়ের কোল থেকে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন। কিন্তু তারপরই তিনি চমকে উঠলেন। “একী বাঁ কানের উপর সেই ফুটোটা কই? তবে কি বাচ্চা বদল হয়ে গেল?” খোঁজ খোঁজ। সারা হাসপাতাল জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। অনেক খোঁজার পর বাচ্চাটিকে অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল। সদ্যোজাত শিশুটি হেসে হেসে খেলা করছিল এক জেলেনীর কোলে। নানুকাকাই সেই শিশুকে চিনতে পেরেছিলেন তাঁর জন্মচিহ্ন দেখে। তাঁর আত্মজীবনী ‘সানির দিনগুলি’তে সুনীল গাভাস্কার বলেছিলেন যে “আমি কখনই ক্রিকেটার হতে পারতাম না এবং এই বইটিও লেখা হত না যদি না আমার জীবনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন নারায়ণ মাসুরকর (নানুকাকা) না থাকতেন”।
১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর টেস্ট ক্রিকেট অভিষেক। ওয়েস্ট ইন্ডিজে তখন ক্লাইভ লয়েড,গ্যারি সোবার্সের মতো ক্রিকেট দৈত্যরা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ ইনিংসে এক বিশাল রান টার্গেট দেয়। গাভাস্কার প্রথম ইনিংসে ৬৩ ও শেষ ইনিংসে ৬৭ রানে অপরাজিত থেকে শুধু নিজেকে প্রমান করে তো দিলেনই, এনে দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম জয়। পরের ম্যাচে দুই ইনিংসে করলেন ১১৬ আর ৬৪। চতুর্থ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫০১ রানের পাহাড় প্রমাণ টার্গেট। কিন্তু সেখানেও তাঁর লড়াইতে সুনিশ্চিত হার বাঁচাল ভারতের। পঞ্চম টেস্টে তাঁর ব্যাট থেকে দুই ইনিংসে এল যথাক্রমে ১২৪ আর ২২০। সর্বমোট গোটা সিরিজে তার একার রানই সাড়ে সাতশোর বেশী। কেবল রান নয়, অনবদ্য সব টেকনিক, দুর্দান্ত রিফ্লেক্স। উত্থাল ক্যারিবিয়ান সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে একের পর এক আর ছেলেটা হেলমেট ছাড়াই সাহসী যোদ্ধার মতো সামলে নিচ্ছে সেই সব ঢেউ। কবি লর্ড রিলেটর তার ব্যাটিং দেখে ক্যালিপসো রচনা করেছিলেন- “De Real Master,/Just Like a wall,/We could not out Gavaskar at all,not at all./You know the West Indies couldn’t out Gavaskar at all”।


টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচের প্রায় একশো বছর পর ১৯৭১ সালে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়। তার ঠিক চার বছরের মাথায় শুরু হয় বিশ্বকাপ। ১৯৭৫-এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ছাড়া অন্য কারও ওয়ানডে ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা ছিল না। ভারত বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলে ৭ জুন লর্ডসে। এর আগে তারা মোট দুটি ওয়ানডে খেলেছিল।
টস জিতে ব্যাটিং উইকেটে ব্যাটিং করতে নেমে ইংল্যান্ড ৬০ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৩৪ রান। ওপেনার ডেনিস অ্যামিস ১৪৭ বলে ১৩৭। চাপের হলেও ভারতের হাল ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা নয়। কারণ ভরসা সুনীল গাভাস্কার।

কিন্তু গাভাস্কারই সেদিন এমন ব্যাটিং করলেন, সেদিনের কথা উঠলে লিটল মাস্টার নিজেই লজ্জায় লাল হয়ে যান। সেদিন পুরো ৬০ ওভারই উইকেটে টিকে ছিলেন। খেলেছিলেন ১৭৪ বল, রান করেছিলেন ৩৬অপরাজিত। গাভাস্কারের সেদিনের ব্যাটিংয়ের জেরে ভারতের স্কোরকার্ডও মাত্র ৩ উইকেট হারিয়ে ৬০ ওভারে রান দাঁড়ায় ১৩২। অর্থাৎ ৭ উইকেট হাতে রেখেও ২০২ রানের বিশাল পরাজয়।

টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনি অন্যতম সফল ওপেনার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আস্ট্রেলিয়ার বিধ্বংসী পেস বোলারদের সময়ে তিনি ১০ হাজারের বেশি রান করেছিলেন। কিন্তু একদিনের প্রথম বিশ্বকাপেও যে তিনি এমন একটা টেস্ট ম্যাচ খেলবেন তা বোধ হয় গাভাসকার নিজেও সেদিন বা তার পরেও ভাবতে পারেননি।
সর্বকালের আলোচিত ব্যাটসম্যান গাভাস্কারের সেদিনের ইনিংস কিন্তু ভীষণ ভাবেই সমালোচিত হয়েছিল। তার আগে ভারতের ওয়ানডে খেলার তেমন অভিঙ্গতা ছিল না ঠিকই, তাতেও গাভাস্কারকে ছাড় দেওয়া যায়নি। কারণ একই ম্যাচে ইংল্যান্ড ৩৩৪ রান করে। ডেনিস অ্যামিস ১৩৭ ছাড়াও ক্রিস ওল্ড ৩০ বলে ৫১ রান করেন।
কিন্তু ওই রকম মন্থর ব্যাটিংয়ের কারণ কী? ম্যাচ শেষে ভারতীয় দলের ম্যানেজার জি এস রামচাঁদ জানিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডের রান তাড়া করা বা টপকানো অসম্ভব মনে করেছিলেন গাভাস্কার। তিনি নাকি পরের ম্যাচগুলোর জন্য ব্যাটিং অনুশীলন করেছেন এই ম্যাচে। রামচাঁদের ওই যুক্তি ধোপে টেকেনি। বেশ কিছুদিন গাভাস্কার মুখে কুলুপ এঁটে রাখলেও পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, ওটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ইনিংস। ওটা এমন একটা ইনিংস ছিল, যার কোনো ব্যাখ্যা তাঁর কাছে নেই। খেলার সময় গাভাস্কার এতটাই চাপে ছিলেন যে বেশ কয়েকবার এমনও হয়েছে, তিনি স্টাম্প ছেড়ে দিয়েও দাঁড়িয়ে ছিলেন, যাতে বোলার তাঁকে বোল্ড করতে পারে।
3 Comments
গাভাস্কারের জীবনে নানুকাকার ঘটনা জানা ছিল না, ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।
গাভাস্কার যখন খেলা ছাড়ছেন তখন আমি সদ্য কৈশোর পেরচ্ছি, তখন থেকেই শুনতাম তিনি নাকি নিজের রেকর্ডের জন্য খেলতেন। ওঁর রেকর্ডগুলো কি দেশের জয় পরাজয়ে কাজে লেগেছে?
এখন ভাবি, গাভাসকর ওঁর ছত্রিশ রানের ইনিংসে নিজেই কমেন্টারি করলে কী বলতেন।