অচিনপুর

আজব গাঁয়ের আজব ভাষা

By admin

June 05, 2024

এমনও কোনও এক গ্রাম রয়েছে যেখানে কোনও মানুষ কথা বলেন না বা কানে শোনেন না। তাহলে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে ভাবনা বা ভাব বিনিময় করেন কীভাবে? তাঁদের আছে নিজস্ব সাঙ্কেতিক ভাষা। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটা সত্যি! হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে আছে রয়েছে সেই গ্রাম, যে গ্রামের প্রায় প্রত্যেক মানুষ মূক ও বধির। জম্মু ও কাশ্মীরের পার্বত্য ডোডা জেলায় অবস্থিত এই গ্রাম, যার নাম দাধকাই। কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে প্রায় ২৮০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই গ্রাম। হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে হওয়ায় সব সময়ই এখানে শুষ্ক আবহাওয়া এবং শীতের পরিমাণ বেশি। অনেক সময় তুষারপাতও হয়। এই গ্রামে প্রায় ৩০০টি পরিবার বসবাস করে, যেখানে প্রায় ৩০০০ মানুষের বসবাস। ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আধা যাযাবর মানুষের বাস এখানে। কৃষিকাজ এবং পশু পালনের মাধ্যমেই তাঁদের জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে।

প্রথম থেকেই কী এখানকার সব মানুষ মূক ও বধির ছিলেন? জানা যায়, ১৯০১ সালে গ্রামের একটি পরিবারের ছেলে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। পরবর্তীতে দেখা যায়, এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মানুষের জন্ম আরও বাড়তে থাকে যেটির সংখ্যা ১৯৯০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জন। আবার ২০০৭ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৭৯ জন। আবার ২০২৩ সালের একটি হিসাব অনুযায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ জন। আবার দেখা গেল, এই মূক ও বধির সমস্ত মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা সব থেকে বেশি। বাবা এবং মা দুজনের বাকশক্তি অথবা শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক থাকলেও সন্তান মূক-বধির, এমনটাও দেখা যায়।

এই ধরণের ঘটনা নজরে আসে ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর ২০১৭ সালে প্রকাশিত একটি জার্নালের উদ্যোগে ধাদকাই গ্রামের মানুষদের ওপর বিভিন্ন জেনেটিক পরীক্ষা চালানো হয়। সেই গবেষণায় দেখা যায় এই গ্রামের মানুষদের জেনেটিক মিউটেশনের কারণে অটোফেরলিন নামক প্রোটিনের ঘাটতি রয়েছে। এই প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দিলে মানুষের মধ্যে শ্রবণশক্তি ও বাকশক্তি হ্রাস পায়।পরবর্তীতে ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিউম্যান জেনেটিক্স-এর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সম্প্রদায়টির নিকট আত্মীয়দের মধ্যে বংশবৃদ্ধির কারণেই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মূক-বধিরতা বেড়ে গিয়েছে। গ্রামে বাসিন্দারা এখনও সেই রীতিনীতি বজায় রাখার কারণেই বর্তমানেও এই মূক ও বধির মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ডোডা এলাকার এই ধাদকাহি তাই ‘নীরব গ্রাম’ নামেই খ্যাত। তবে এও দেখা গেল সম্প্রতি নির্বাচনে জম্মু ও কাশ্মীরের এই ‘নীরব গ্রাম’ দল বেঁধে দাঁড়াল ভোটের লাইনে। সড়ক, জল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বুনিয়াদি সুযোগ সুবিধা মেলার আশায়। তবে দাবি পূরণ না হলে ভবিষ্যতে ভোট বয়কটের হুমকিও দিয়ে রাখলেন তাঁরা।

ধাদকাহিতে মূলত গুজ্জর সম্প্রদায়ের বাস। এখানে কিছু কৃষিকাজ হয়। জানা গেল, প্রাথমিক সুযোগ সুবিধাগুলি পেতে তাঁরা দীর্ঘদিন সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁরা চাইছেন মূক ও বধির শিশুগুলির জন্য গ্রামে স্কুল তৈরি হোক। প্রাথমিক স্কুলের জন্য শিক্ষক, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন চিকিৎসক, গ্রামের সঙ্গে মূল সড়কের সংযোগ— এইসব পরিষেবাই দাবি গ্রামবাসীদের। হাতের ইশারায় তাঁরা  বুঝিয়ে দিয়েছেন, স্কুল, রাস্তা, স্বাস্থ্যকেন্দ্র না মিললে আগামী বিধানসভা ভোট সহ সব নির্বাচনই বয়কট করা হবে।

আরো জানা গিয়েছে, অতীতে মূক-বধির গ্রামবাসীদের জন্য সঙ্গী খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। বছরের পর বছর ধরে বধির অথবা বোবা মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দাধকাইয়ের সামাজিক দৃশ্যপট বদলে গিয়েছে। বয়স্করা মনে করেন, গ্রামে যদি একটি সাংকেতিক ভাষার স্কুল থাকত তাহলে তাদের জন্য পরিস্থিতি অন্যরকম হত। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় কয়েক দশক ধরে দাধকাইয়ের গ্রামবাসীরা তাদের নিজস্ব একটি সাংকেতিক ভাষা তৈরি করেছেন। এখানে বসবাসকারী এখন সকলেই এই ভাষা বুঝতে পারে। অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এটি করা হয় এবং প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি একটি স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে।’নারী’ বোঝাতে গ্রামটিতে একজন নাকের পাশে নির্দেশ করেন, কারণ গ্রামের নারীদের নাক প্রথাগত অলংকার পড়ার জন্য ছিদ্র করা। দাড়িতে হাত বুলিয়ে ‘পুরুষ’ বোঝানো হয়।