রূপকথার গ্রাম বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। দেখতে যে কেবল সুন্দর তাই নয়, ছবির মতো সুন্দর, কোথাও কোনো শব্দ নেই। রূপকথার এই অপরূপ সুন্দর রাজ্যটি হল ‘খিতুর্ন’ গ্রাম। যে গ্রামের ঠিকানা নেদারল্যান্ডস। সবুজে ঘেরা জাদুকরী এই গ্রামটি পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। গ্রামটিকে ‘নেদারল্যান্ডসের ভেনিস’ও বলা হয়। অন্যান্য যে কোনো গ্রামের থেকে এই গ্রামটি শুধু জে আলাদা তাই নয়, এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই গ্রামে যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। আর সেই কারণেই কোনো গাড়ি বা হর্নের শব্দ শোনা যায় না। গ্রামটিতে যেতে হলে গাড়ি গ্রামের বাইরেই রেখে যেতে হয়। তবে গ্রামে যাতায়াতের রাস্তা আছে সেই রাস্তা হল জলপথ। গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে এখানকার বাসিন্দারা নৌকা ব্যবহার করেন। গ্রামের শান্ত পরিবেশ বজায় রাখতে নৌকাগুলিতে ব্যবহার করা হয় শব্দ বিহীন ইঞ্জিন। জানা যায়, এই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মাটির নীচে ছোট-বড় ফাঁপা অংশ ছিল। গ্রামে মানুষ বসবাস শুরু করার পর সেগুলি খুঁড়ে বার করা শুরু হয়। বছরের পর বছর ধরে সেগুলি খুঁড়ে বার করার ফলে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো খাল তৈরি হয়। সেই খালগুলির একটির সঙ্গে আরেকটি সংযোগ করে এই গ্রামে যাতায়াতের জলপথ তৈরি হয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন দিক থেকে খালগুলি চলে যাওযায় গ্রামটিও ছোট ছোট দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ওই দ্বীপগুলির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করেছে ১৫০টিরও বেশি সেতু। রাজধানী আমস্টারডাম থেকে এই গ্রামটির দুরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। বাস বা ট্রেনে সহজেই যাওয়া যায় এই গ্রামের সীমানায়। ডাচ ফিল্মমেকার বার্ট হান্সট্রা তার কমেডি ফিল্ম ‘ফ্যানফেয়ার’-এর শুটিং এ গ্রামে করার পর ১৯৫৮ সালে গ্রামটা বিশ্বের নজরে আসে।
ইতালির ভেনিস শহর পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য। ভেনিসজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল। এসব খালের জলে গন্ডোলায় বা নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে অনেকেই। তবে ভেনিসের কথা আমরা যতটা জানি, ডাচ গ্রাম খিতুর্নের কথা আমরা সেভাবে জানি না। জানলে অনিন্দ্য সুন্দর এই গ্রামটি জীবনে অন্তত একবার ঘুরে দেখার স্বপ্ন মনে মনে উঁকি দিতে বাধ্য। ‘ভেনিস অব দ্য নর্থ’ হিসেবে পরিচিত নেদারল্যান্ডসের এই গ্রামটি ১২৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই বছর ফ্ল্যাগেলান্ট নামের একটি বিদ্রোহী ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা সুনসান এক অঞ্চলে গিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর আগে খাল দিয়ে ঘেরা ওই অঞ্চলে কোনো মানুষের বাসস্থান ছিল না। বর্তমানে সেই জায়গার নাম খিতুর্ন। ইংরেজিতে এর বানান Giethoorn। ফলে এর প্রচলিত উচ্চারণ গিথোর্ন। তবে ডাচ ভাষায় G-এর উচ্চারণ অনেকটা বাংলা ‘খ’ বা ইংরেজি ‘ch’-এর মতো। এই ভাষায় ‘th’টাও আসলে ‘ত’ বা ‘দ’-এর মতো, ‘থ’-এর মতো নয়। ফলে Giethoorn-এর উচ্চারণ হিসেবে ‘গিথোর্ন’ বেশ প্রচলিত হলেও এর উচ্চারণ আসলে অনেকটা ‘খিতুর্ন’-এর মতো শোনায়। Giethoorn শব্দটা এসেছে ইংরেজি গোট হর্ন (Goat Horn) বা ডাচ Geytenhoren, অর্থাৎ ছাগলের শিং থেকে। ফ্ল্যাগেলান্টরা যখন এখানে গিয়েছিল, তখন তারা দেখেছিল মাটিতে অনেক ছাগলের শিং গেঁথে আছে। ধারণা করা হয়, ১১৭০ সালের বন্যায় এসব ছাগল মারা গিয়েছিল।
একসময় জলপথ ছাড়া খিতুর্নে চলাফেরা করার তেমন কোনো উপায় ছিল না। পরবর্তীতে সেখানে খালের ওপর ১৮০টি পদচারী-সেতু হয়েছে। এখন খিতুর্নে যাতায়াত করার দুটি উপায় আছে। গ্রামটি ঘুরে দেখার সময় নৌকায় তা না হলে পায়ে হেঁটে। খিতুর্ন নেদারল্যান্ডসের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ডাচ প্রদেশ ওফেরাইসেলে (Overijssel) অবস্থিত গ্রামটি ‘ভেনিস অব দ্য নর্থ’ উপাধি পেলেও কিন্তু এটি ইতালির ভেনিসের আদলে গড়া হয়নি। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে ঘুরে দেখলে বোঝা যায়, এই দেশে খালের কোনো অভাব নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে খিতুর্ন ইতালির ভেনিসের চেয়েও মনোরম বলে অনেকে মনে করেন। খিতুর্ন ঘুরে দেখার এই গ্রামের মোহনীয় রূপ উপভোগ করার শ্রেষ্ঠ সময় গ্রীষ্ম আর বসন্তকাল। কারণ, মিষ্টি রোদ আর ফুলের সৌরভের মধ্যে এই গ্রাম ঘুরে দেখার আনন্দ অন্য রকম।
খিতুর্ন গ্রামের একটি জাদুঘরে এলিফ্যান্ট বার্ড নামের একটি বিলুপ্ত প্রজাতির পাখির এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় ডিম দেখা যায়। গ্লোরিয়ামারিস পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সি-শেল বা খোলস হিসেবে পরিচিত। এই শেল পাওয়া যায় একধরনের সামুদ্রিক শামুক থেকে। এই শামুক কেবল প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারতীয় মহাসাগরে দেখা যায়। অনেক মূল্যবান একটি গ্লোরিয়ামারিস শেল আছে খিতুর্ন গ্রামে। আর যে জাদুঘরে এই শেল রাখা আছে, তার নাম গ্লোরিয়া মারিস শেল গ্যালারি। গ্লোরিয়ামারিস ছাড়াও এখানে সমুদ্রের তলদেশ থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন জিনিসপত্র আছে।