এক নজরে

এখনও দেশে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ ক্রীতদাস প্রথায় বাধ্য

By admin

December 22, 2024

সভ্যতার সৃষ্টির পরপরই সামাজিক ব্যাধির মতো চালু হয়েছিল ক্রীতদাস প্রথা। এরপর সময় যত এগিয়েছে, বেড়েছে তাদের প্রতি অমানবিক নির্যাতন। মানুষ হিসেবে তাদের প্রায় সব অধিকার কেড়ে নিয়ে এক অভিশপ্ত জীবনে ঠেলে দেওয়া তাদের। পশুর মতো পোষ্য মনে করা হত তাদের। সেই প্রথা ক্রীতদাস প্রথা। যার ইতিহাস অতি প্রাচীন। যতদূর জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথার চালু। তারও হাজার খানেক বছর পর থেকে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে মিশর আর ভারতে। তারও অনেক অনেক পরে চীনে জাঁকিয়ে বসে অমানবিক এই প্রথা। ৮০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসে এবং ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথা। অনেকটা সিঁড়ি বেয়ে অমানবিকতার শীর্ষে উঠবার প্রক্রিয়া। এই ভাবে প্রায় পুরো বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়ে ক্রীতদাস প্রথা। ওদের আর্তনাদ ধ্বনিত হতে থাকে সব জায়গায়।

পৃথিবী থেকে বহু দিন আগেই ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু গত কয়েক বছরে গোটা বিশ্বে আধুনিক দাসত্ব ব্যবস্থা বা ‘সভ্যযুগীয় দাসত্ব’ বেড়ে গিয়েছে। প্রায় প্রতিদিন বিশ্বের বহু শিশু, নারী, পুরুষ, প্রবীণ এই সভ্যযুগীয় দাসপ্রথার বলি হচ্ছেন। কখনও গোচরে, কখনও অগোচরে। সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০২১ সালের আগে বিশ্বে সংখ্যাটা এক কোটি কম ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এক কোটি মানুষ এই আধুনিক দাসখতের আওতায় এসেছেন। অন্যান্য অসংখ্য কারণ ছাড়াও মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান জটিলতর সমস্যা, পরিবেশের উপর দূষণজনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং কোভিড ১৯-এর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। সভ্যসমাজের আধুনিক দাসত্বের নেপথ্যে রয়েছে, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে শ্রমিক হতে বাধ্য করা, ঋণখেলাপিকে ক্রীতদাসে পরিণত করা, জোর করে বিয়ে, সাধারণ দাসত্ব এবং দাসত্বের অনুরূপ কাজকারবার, সর্বোপরি শিশু ও নারী পাচার। সমীক্ষায় জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, আধুনিক যুগের দাসত্ব চোখে দেখা যায় না। খালি চোখে বোঝাও যায় না। এই ব্যবস্থা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও সমাজের গভীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু খণ্ডাংশে নয়, গোটা পৃথিবীতেই সূক্ষ্মভাবে গোপনে আমাদের দাসত্বে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিদিন মানুষকে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে, বাধ্য করা হচ্ছে অথবা জোর করে শোষিত হওয়ার পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে মানুষকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যেখান থেকে তার নিষ্কৃতি বা পরিত্রাণের কোনও উপায় নেই।

সমীক্ষা বলছে, প্রতিদিন আমরা যেসব সামগ্রী কিনি কিংবা যেসব পরিষেবা ব্যবহার করি সেগুলি আমাদের ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয় অথবা আমাদের ব্যবহারের বুদ্ধি অর্থাৎ প্রস্তাব দেওয়া হয়। আমরা টেরই পাই না, এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে গোপন মানব শ্রমের মূল্য। সমীক্ষা বলছে, সভ্যযুগীয় দাসত্বে ২ কোটি ৭৬ লক্ষ মানুষকে জোর করে শ্রমিকের কাজ করানো হয়। ২ কোটি ২০ লক্ষ বিয়ে দেওয়া হয় পাত্র বা পাত্রীর অমতে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রতি দেড়শো জনের মধ্যে একজনের বিয়ে দেওয়া হয় জোর করে। ভারত প্রগতিশীল অর্তনীতির দেশ হিসাবে সাড়া বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। তবে আধুনিক ভারতবর্ষকে পেতে গেলে এখনও অনেক সংগ্রাম করতে হবে। কারণ ভারতে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ দাসত্ব ভোগ করে চলেছেন। প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতোই এই পরিসংখ্যান জানলে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, ভারতের প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ আধুনিক দাসব্যবস্থার শিকার। পৃথিবীতে যেখানে সংখ্যাটা আনুমানিক ৫ কোটি। ওয়াক ফ্রি নামে একটি মানবাধিকার সংস্থা গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স বা বৈশ্বিক দাসত্ব মাপকাঠি প্রকাশ করে সম্প্রতি। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে আনুমানিক ৫ কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বের পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে বাধ্য হন। যার মধ্যে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষই বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের নাগরিক।

উল্লেখ্য, যৌন দাসত্বের কারবারে ভারতের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ। সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ভারতে আধুনিক দাসপ্রথার অংশীদার ১ কোটি ৯০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। এর মধ্যে কাউকে বন্ডে লিখিয়ে জোর করে, কাউকে এমনিই জোর প্রয়োগ করে খাটিয়ে, কাউকে যৌন ব্যবসায় নামিয়ে, ভিক্ষা করিয়ে বা জোর করে বিয়ে করে দাসত্ব করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিশ্বের মোট ১৬৭টি দেশের মধ্যে গড়ের বিচারে ভারতের স্থান ক্রীতদাসত্বের দিক থেকে চতুর্থ। মোট জনসংখ্যার ১.৪ শতাংশ মানুষকে এখানে জোর করে দাসত্ব মেনে নিয়ে বাধ্য করা হয়েছে। আর সংখ্যার বিচারে ভারত জনবহুল দেশ হওয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ভারতীয় দূতাবাসের” সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে মোট ক্রীতদাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন ৪ কোটি ৫৮ লক্ষের বেশি মানুষ। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশই ভারত, চিন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও উজবেকিস্তানের বাসিন্দা। ভারতে বহুদিন আগেই শর্তের বিনিময়ে শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে গ্রামের গরিব মানুষদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে তাদের কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাসত্ব গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। বাড়ির কাজ করানো, ভিক্ষা করানো, যৌন ব্যবসায় ঠেলে নামানো, শিশুশ্রমের মতো ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গ্রামে গরিব কৃষকেরা ঋণের টাকা ফেরত দিতে না পারলে বড় জোতদারদের কাছে বেগার খাটছে। গরিব মহিলারা অন্যের বাড়িতে বিনা টাকায় কাজ করছে। টাকার বদলে জুটছে যৌন অত্যাচার ও নিগ্রহ। কিছুক্ষেত্রে কেন্দ্র সরকার কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে দিনের পর দিনন ভারতের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দাসত্ব মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ভারতের মোট ১৫টি রাজ্য ও ৮০ শতাংশ জনসংখ্যার উপরে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।