সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম পরাধীন ভারতবর্ষে ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বর্তমানের সূর্য সেন স্ট্রীটে। প্রথম দশ বছর কাটিয়েছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। সে সময় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রভাবে কৃষ্ণনগর নাট্যচর্চার একটা কেদ্র ছিল। শুধু তাই নয়,নাটকের বিভিন্ন গোষ্ঠী সেখানকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। ছোটো থেকেই সৌমিত্রবাবু নাট্য মঞ্চের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং সেই পরিমণ্ডলে বড় হয়ে উঠেছিলেন। তার ঠাকুরদা একটি ছোটো নাটকের দলের সভাপতি ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই সৌমিত্র স্কুলে স্কুলে নাটক করতেন। পরবর্তীকালে হাওড়ায় চলে আসেন সৌমিত্র এবং হাওড়া জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে বাংলা সাহিত্য নিয়ে কলকাতার সিটি কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। কিন্তু কলকাতায় এসে থেকেই তিনি প্রথমে অহিন্দ্র চৌধুরী এবং পরে নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির কাছে নাটকের তালিম নেন। নাট্যচর্চার এই পরিমণ্ডল পরে তাকে জাত অভিনেতা তৈরি করেছিল। শিশির ভাদুড়ির নাটকে তিনি ছোটো দু’একটি রোল করেছিলেন বলেও শোনা যায়।
পরবর্তী সময়ে আকাশবাণীর একজন ধারাভাষ্যকার হিসাবে তার কর্মজীবনের সূচনা। কিন্তু অভিনয় তাকে তখনও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে১৯৫৬ সালে সৌমিত্র , সত্যজিৎ রায়ের সংস্পর্শে আসেন। সে সময়টা সত্যজিৎ রায় অপরাজিত-র জন্য একটি নতুন মুখের সন্ধানে ছিলেন। কিন্তু অপরাজিতর অপুর জন্য তার বয়স একটু বেশি মনে হয় সত্যজিতের। পরে তার সুযোগ আসে “অপুর সংসার” ছবি করার সময়। ইতিমধ্যে কার্তিক চট্টোপাধযায়য়ের ” নীলাচলে মহাপ্রভু” ছবিতে স্ক্রিন টেস্টে সৌমিত্র সফল না হয়ে বেশ মুষড়ে আছেন। সত্যজিৎ তাকে প্রথম সযোগ দিলেন ছবি করার । বিপরীতে শর্মিলা ঠাকুর। অপুর সংসারের পরেও শর্মিলার সঙ্গে বেশ কিছু সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে পরবর্তীকালে অভিনয় করেন সৌমিত্র। ” অরণ্যের দিনরাত্রি” তার মধ্যেই একটি ছবি । এর পরে ইতিহাস । কুরসাওয়ার সঙ্গে মিফুনের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সত্যজিতের সঙ্গে সৌমিত্রর সেই একই । পরিচালক আর অভিনেতার এই মধুর সম্পর্কই বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আর তার দর্শকদের একের পর এক ছবি দিয়ে গেছে যা তখনকার দর্শক হলে টিকিট কেটে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছেন। যেমন বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালনা তেমনই বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়। ভুলে গেলে চলবে না সমসাময়িক মহানায়ক উত্তম কুমার কিন্তু সত্যজিতের মাত্র একটি ছবিতেই অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফেলুদার দুটি ছবি – সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ ছাড়াও অভিযান, অশনি সংকেত থেকে শুরু করে গণসত্রু, শাখাপ্রশাখা পর্যন্ত সত্যজিৎ আর সৌমিত্র জুটি বাংলা তথা বিশ্ব সিনেমা জগৎকে একের পর এক উচ্চমার্গের, মনোমুগ্ধকর, ছবি উপহার দিতে গেছেন। অনেকেই বলেন সৌমিত্র কেন হিন্দি ছবিতে অভিনয় করলেন না। আসলে সৌমিত্র বা সত্যজিতের মত শিল্পীদের সেখানে মনে হয় অভিনয় করার দরকার পড়ে না। একটি ভাষায় অভিনয় করে যদি বিশ্ববাসীর মন জয় করা যায, কৃষ্টি বা সংস্কৃতিকে উচ্চমার্গে নিয়ে যাওয়া যায় তবে ভিন্ন ভাষায় কি বা এলো গেলো। কুরসাওয়া বা ফেলিনির ছবি দেখতে যেমন বাঙালির কোনো কষ্ট হয় না সত্যজিৎ – সৌমিত্র দেখতেও বিশ্ববাসীর তেমনি কোনো অসুবিধা হয় নি। জাত শিল্পী ভাষা বা আঞ্চলিকতার উর্ধে। বুদ্ধিমান আর সমজদার দর্শকও তাই।
শুধু কি সত্যজিৎ ? মৃণাল সেন বা তপন সিংহের ছবিগুলিতে সমান সহজ আর সাবলীল সৌমিত্র। আকাশ কুসুম বা ঝিন্দের বন্দী দুটি সিনেমাতেই তো কেল্লা ফতে করেছেন সৌমিত্র। বিশেষ করে বলতে হয় তার ঝিন্দের বন্দির কথা। ভিলেন চরিত্রে অমন অভিনয় একজন প্রতিষ্ঠিত নায়কের কাছ থেকে যে পাওয়া সম্ভব তা সৌমিত্রর আগে বোধহয় বাঙালি জানত না। অপর্ণা থেকে তনুজা, সুচিত্রা, এমনকি ওয়াহিদা রহমান সবার বিপরীতে নায়ক সৌমিত্র। একবারও মনে হয় নি তিনি কিছু কম। টলি বা বলি সব অভিনেত্রীর সঙ্গেই সৌমিত্র মানানসই। পরে গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ সবার ছবি করেছেন সৌমিত্র। তবে কিছু ছবির কথা না বললেই নয়। অগ্রদানী, অন্তর্ধান এবং আতঙ্ক। শেষ দুটি তপন সিংহের পরিচালনা। দুটিতেই অসামান্য অভিনয় ফুটিয়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র বয়স্ক বাবার ভূমিকায়।
এছাড়াও নাটক ও কবিতার শখ ছিল তার সারা জীবন। আবৃত্তির পাশাপাশি লিখেছেন বেশ কিছু কবিতার বই। লেখা থেমে গেলো। নীরব হয়ে গেলেন কবি আর অভিনেতা সৌমিত্র। বেঁচে থাকে তার কীর্তি। যুগে যুগে তৈরি হবে তার অগণিত গুণমুগ্ধ ভক্ত। সৃষ্টির সঙ্গে বেঁচে থাকবেন স্রষ্টা।