ব্রিটিশরা যে দেশটিকে বলত ‘জুয়েল অব দ্য ক্রাউন’সেদেশ নিয়ে আজকের সংবাদ শিরোনাম ‘তেল কেনার লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে দুজনের মৃত্যু’, ‘কাগজেরঅভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারল না’, ‘ডিজেল না থাকায় বাস চলাচল বন্ধ’, ‘জ্বালানির অভাবে উৎপাদন ব্যাহত; টানা ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন’, ‘বিদ্যুৎ-সংকটে শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ’, ‘প্যারাসিটামলের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ’ ইত্যাদি। দেশটিতে গত ১২ মার্চ রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস কোম্পানি পেট্রলের দাম ৪৩.৫ শতাংশ বাড়িয়েছে, ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে ৪৫.৫ শতাংশ। সে দেশেতীব্রতর অর্থসংকট ও বেকারত্ব মাত্রা ছাড়িয়েছে।দেশটির সরকারের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় নেই, যে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানিসহ জরুরি পণ্য আমদানি করতে পারছে না সরকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা আজ এমনই সংকটজনক পরিস্থিতিতে।
দেশটিতে দৈনিক পত্রিকা ছাপা বন্ধ হয়েছে, প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে সরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে,এক কেজি চাল বিকোচ্ছে ৫০০ টাকায়, ৪০০ গ্রাম মিল্ক পাউডারের দাম ৭৯০ টাকা, চিনির কেজি ২৯০ টাকা! ৭৫ বছরে লঙ্কাবাসী এত দুর্দশা কি দেখেছে কোনওদিন? লঙ্কা সরকার এই সংকটকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও কোভিড মহামারির ফল বলে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা আদতে তা নয়। ১৯৮৯ সালে গৃহযুদ্ধের সময়েএই অস্বাভাবিক মন্দার পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। তখনও শ্রীলঙ্কা ছেড়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের তামিল অধ্যুষিত এলাকাগুলো থেকে মানুষ শরনার্থী হয়ে ভারতে ঢুকতে শুরু করেছে।

গ্যাস ও তেল নির্ভর দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদন কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তেল-গ্যাস না পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন গিয়েছে কমে। ফলে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বিদ্যুৎ বিভাগ প্রতিদিন সাড়ে সাত ঘণ্টা লোডশেডিং শুরু করেছে। বিদ্যুতের ঘাটতি, গ্যাস–সংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ছোটখাটো ব্যবসায়।গত ফেব্রুয়ারিতে পণ্যের দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি, যা বিগত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। প্রশ্ন; কীভাবে শ্রীলঙ্কা শ্রী-হারা হল? কেন দু’দশক আগেও সমৃদ্ধ থাকা দেশটি দেউলিয়া হওয়ার রাস্তায়?
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক নৈরাজ্য একদিনের নয় তবে তার উৎস রাজনীতি। যেখানে ক্ষমতাসীন পরিবার দেশ পরিচালনা করে রাজতান্ত্রিক কায়দায়। একই পরিবারের ২০ জনের বেশি রয়েছেন সে দেশটির শাসন কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, সেচমন্ত্রী ও যুবমন্ত্রী রাজাপক্ষে পরিবারের এবং প্রথম চারজন হলেন ভাই। তাছাড়া ওই পরিবারের ৯ সদস্য আছেন ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে। দেশটির নাগরিকেরা গত দুই জাতীয় নির্বাচনে উদার হৃদয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ রাজাপক্ষেদের হাতে সঁপেছিলেন। কারণ, রাজাপক্ষেরা আশা জাগিয়েছিল তামিল ও মুসলমানদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রেখে বৌদ্ধ-সিংহলিদের উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এখন বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় যে কোনো পণ্য অমিল, পাওয়া গেলে দাম লাগামহীন।গত কয়েক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় বাজেটের ৭৫ ভাগ খরচ হয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা রাজাপক্ষে গোত্রের ২০-২৫ সদস্যের হাত দিয়ে। ফলে শাসক পরিবারের মনের খেয়ালে নেওয়া সিদ্ধান্তের দায় শোধ করতে হচ্ছে গোটা দেশকে।

লঙ্কা প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষে বছর দুই আগে আচমকাই করের হার কমিয়ে দিলেন। বলা বাহুল্য, যে কোনও সিধ্যান্ত নেওয়া হয় পূর্বপ্রস্তুতি এবং বিকল্প ভেবে কিন্তু তিনি আচমকাই সিদ্ধান্ত নিলেন; কৃষিকে একশো ভাগ রাসায়নিক সারমুক্ত করবেন। এ ছাড়া গত দু’দশক ধরে ‘উন্নয়নের চমক’ দেখাতে বিদেশি ঋণে এমন সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যেখান আয় তো কিছু হয়নি বরং সেসব প্রকল্প-ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধের সময় হয়ে গিয়েছে।

রাজাপক্ষে আমলে চীনের ঋণে তৈরি হামবানটোটা সমুদ্রবন্দর এবং পাশের মাত্তালায় বানানো ‘রাজাপক্ষে বিমানবন্দর’ থেকে প্রত্যাশা মতো আয় হল না। বরং দেনা মেটাতে চীনের কাছেই সোয়া বিলিয়ন ডলারে লিজ দিতে হয়েছে। ওই লিজে পাওয়া অর্থও ইতিমধ্যে হারিয়ে গিয়েছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কালো গহ্বরে। চীন ছাড়াও শ্রীলঙ্কা বড় অঙ্কের ঋণ আছে এডিবি, বিশ্বব্যাংক ও জাপানের কাছে। আন্তর্জাতিক অর্থবাজার থেকে বিভিন্ন সময় আরও নানান ধরনের ঋণ এখন শ্রীলঙ্কার গলার ফাঁস হয়ে উঠেছে। আশঙ্কা দেশটি হয়তো এ বছর বিদেশি দেনার কিস্তি শোধ দিতে পারবে না। বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগারে দু’বছর আগেও ছিল সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি। এখন সেটা দুই বিলিয়নের নিচে নেমেছে।

গত ৪৫ বছরে গণতন্ত্রের আড়ালে সেনানায়েক, বন্দরনায়েক এখন রাজাপক্ষে পরিবার তামিল ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও গুলি ছুড়ে রাজনীতি করেছে কিন্তু পর্যটন ও চা–শিল্পের বাইরে অর্থনীতিকে বহুমুখী করেনি। অনেকের মতে, করোনাকাল দেশটির আজকের পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। কিন্তু মহামারি সব দেশকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ফেলেছে কিন্তু কেউ তাদের মতো বেসামাল হয়নি। ‘উন্নয়নের চমক’ দেখাতে যেসব কৌশল নিয়েছিল তা আসলে ঔপনিবেশিক স্থিতিশীলতার ভেতর রাজতন্ত্র কায়েম রাখা। কোভিড ও পর্যটন শিল্পে ধাক্কা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেলেও মনে রাখা দরকার, পর্যটন থেকে দেশটির বছরে আয় হয় ৪০০ কোটি ডলার যা দেশটির অভ্যন্তরীণ আয়ের মোট অর্থের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকৃত জিডিপিতে পর্যটনের অবদান মাত্র ১.৫ শতাংশ।
২০০৫ সালে শ্রীলঙ্কার জিডিপির ২৬ শতাংশ এসেছিল রপ্তানি থেকে। ২০১০ সালে সেটা নেমে হয় ১৫ শতাংশ এবং ২০২০ সালে তা ১২ শতাংশে নেমে আসে। তার মানে দেশীয় অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারার মতো চাহিদা তৈরি করতে পারেনি, তাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নামতেই থাকে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪.৩ শতাংশ, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই হার ১৭.৫ শতাংশে নামে। তাছাড়া সরকার আচমকা জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদের সিধ্যান্ত নিলে কৃষি উৎপাদন ভয়াবহ ভাবে কমতে থাকে। আজ শ্রীলঙ্কার ঘাড়ে ৮৯০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ যা আগামী ১২ মাসের মধ্যে শোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
3 Comments
২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের দেশে বর্তমানে এক আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যাচ্ছিল ২৭৭ শ্রীলঙ্কান টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে দুগ্ধজাতীয় পণ্য, গাড়ি ইত্যাদি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরিস্থিতি সামলাতে ৪৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝার পরও রাজাপক্ষের সরকার চীন ও ভারতের সাহায্য প্রার্থী।
শ্রীলঙ্কায় প্রচুর চীনা শ্রমিক কাজ করে অথচ শ্রীলঙ্কান আদিবাসীরা বেকার। চীন আজ অর্থসংকটের জন্য শ্রীলঙ্কাকে দায়ী করছে কিন্তু তারাই সমুদ্র বন্দর গড়ার ঋণ দিয়েছিল যে বন্দরের কারণে উপকূলরেখা, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র প্রায় ধ্বংসের পথে।
চাপের মুখে ২৬ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে, প্রধানমন্ত্রী কি করেন তার অপেক্ষা।