কলকাতা ব্যুরো: তিনি চলে গেছেন মাত্র কিছুক্ষণ আগে। এদের কেউ এক সময় তার সঙ্গে অভিনয় করেছেন, কেউবা ছিলেন শুধুই গুনগ্রাহী, কেউবা কিছুটা তফাত থেকে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পেরেছিলেন। তারা আজ বাকহারা। কেউবা কথা বলার অবস্থায় নেই। কেউবা ছুড়ে দিলেন টুকরো অভিজ্ঞতা।

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় –বাকরুদ্ধ সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ফোনটি ধরে বললেন, গত ক’দিন ধরেই টিভিতে খবর নিচ্ছিলাম, ও কেমন আছে! কিন্তু আজ আর কিছু বলার নেই। কিছু বলতে পারছি না। সৌমিত্র বেঁচে থাকবে, ওর হাসিতে, ওর কথায়, অভিনয় নিয়ে বেঁচে থাকবে ও।

দীপঙ্কর দে –আমার খাতায় একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। কলেজে ভর্তি হই সে সময়ই আলাপ ওনার সঙ্গে। সেই সময় থেকেই প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে ওনার সঙ্গে আলাপ। আমাদের বাড়িতে তখন একটা ল্যান্ডলাইন ফোন ছিল। সৌমিত্রদার বাড়িতে তখনও ফোন আসেনি। তাই আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসতেন ফোন করতে বা ফোন রিসিভ করতে। তারপরই হত কথাবার্তা, গল্প। তখনই একদিন আমার খাতায় একটা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন।

সন্দীপ রায় –১৯৫৯ সালে অপুর সংসার দিয়ে শুরু সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা। তিনি ভীষণভাবে রোল নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেন। বাবা ওকে ভীষণ স্বাধীনতা দিতেন। ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত কেমিস্ট্রি ছিল। ৬০ বছর ধরে মানুষটা দিয়ে গিয়েছেন। অশনি সংকেত সিনেমাটা করার সময় তিনি একটা ডাইরি লিখতেন। যা অন্য কোন সিনেমার ক্ষেত্রে দেখি নি। বিভিন্ন পরিচালকের বহু সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা অবাক করার মত। শুধু অভিনয়ই নয়, ওকে দেখেছি সব রকমের পড়াশোনা করতে। শুটিংয়ে গিয়ে ওকে ট্রলি ঠেলতেও দেখেছি। হয়তো লোক কম ছিল। কিন্তু তার নিয়ে কোন জড়তা ছিল না। ওর মতো পন্ডিত মানুষ খুব কম ছিল।

অপর্ণা সেন –পারমিতার একদিন ওনার জীবনের অন্যতম একটা সেরা ছবি বলে মনে করি। এই প্রসঙ্গে কত অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত স্তরে। সব বলা হয়ে উঠবে না। ওকে নিয়ে বেশী ছবি করতে পারীনি তা নিয়েও একটু অভিমান ছিল। আমাকে সবসময় বড় ডিরেক্টার বলে ক্ষ্যাপা তো। ওকে কোনো চরিত্র নিয়ে বেশি বলার দরকার হতো না। তবুও মাঝে মাঝে কিছু বিষয় হয়তো বললাম। একটু আমার মতো করে অভিনয় করবেন? হ্যাঁ… বল… বল। কোনো সিনেমা সেন্সরের ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও ব্যান করার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। ওর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক ভাবনায় কিছু হয়তো তফাৎ ছিল নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রে। কিন্তু আসলে মনে হচ্ছে মাথার উপর থেকে ছাদ টা সরে গেল। বহমান সিনেমাটা করতে একসঙ্গে দুজনে বিদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে একটা ওকে বই কিনে দিয়েছিলাম।

গৌতম ঘোষ – – আমরা এতদিন উৎকণ্ঠতেই ছিলাম। আমি আজ বলি, দেখা সিনেমাটা আমি আর সলিল দা, সৌমিত্রদার কথা ভেবেই তৈরি করেছিলাম। সৌমিত্র দা ছাড়া ওই ছবিটা ওই ভাবে কেউ তুলতে পারত না। একজন রাজার মতো কাটিয়েছেন অভিনয় নাটক কবিতার মধ্যে। এত বড় মাপের একজন শিল্পী হলেও মাটিতেই ছুঁয়ে থাকতেন। গ্ল্যামার দূরে রেখে তিনি ছিলেন মাটির কাছে। বঙ্গীয় নবজাগরণের প্রভাব কিছু মানুষের মধ্যে ছিল তার অন্যতম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। কাজের আনন্দ কাজ করা এমন আনন্দ পেয়ে অভিনয় করা এটা সৌমিত্রর মধ্যে দেখেছি।

জয় গোস্বামী — একটা যুগের শেষ হলো। এমন কোন চলচ্চিত্র অভিনেতা নেই, যার কবিতাসমগ্র আছে, নাটকসমগ্র আছে। সত্যজিৎ রায়ের ১৪ টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। নাটক করেছেন। যা কোনদিন মানুষ ভুলবে না। আমার লেখা উনি পড়ছেন। এ কি কম পাওয়া! তিন দিন তার জন্য নিজে রিহার্সালে এসেছিলেন। উনি পড়ার পরে আমায় জিজ্ঞেস করছেন, জয়, ঠিক আছে তো? আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। কতখানি পারফেকশন আসলে এটা করতে পারেন। আর অহংকার শূন্য হলে এটা কতটা করা সম্ভব।

শর্মিলা ঠাকুর — আমার খুব ভালো বন্ধু চলে গেল। ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ভাবছিলাম, হয়তো সুস্থ হয়ে ফিরবে। এত ভাল মানুষ তার সঙ্গে কবিতা, লেখা লেখি, স্বপ্ন পূরনের শিল্পী তিনি। আমার সঙ্গে সম্পর্কটা ছিল অন্যরকম। আবার অরণ্যে দিনরাত্রি ও আবার অরণ্যে শুটিংয়ের জন্য উত্তরবঙ্গ, আসামে দীর্ঘদিন ছিলাম। শুটিংয়ের পরে যখন আড্ডা মারতাম, তখন বুঝে ছি, কি বড় মাপের পন্ডিত মানুষ তিনি। কত কিছু শেখার আছে ওর কাছ থেকে ভাবতাম। এখন আক্ষেপ হয়, কেন সে সব কথাগুলো ওর রেকর্ড করিনি।

স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত –কেন ও সিনেমায় নামছে না। বিভিন্ন লোককে বলতেন সৌমিত্র বাবু। স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত জানালেন এক লিজেন্ড এর বিদায়।