কলকাতা ব্যুরো: মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তদন্ত গুটিয়ে নিয়ে একটি চিটফান্ড সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করলো সিবিআই। চার্জশিটে নাম রয়েছে ওই চিটফান্ড সংস্থার মালিক সহ পুলিশের বেশকিছু বড়, মেজ, সেজ কর্তারও। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে চার হাজার কোটি টাকার এই আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ একসময় প্রভাবশালী মহলের অঙ্গুলিহেলনে রাজ্য পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছিল বলে অভিযোগ।কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে আই এম এ নামে ওই বেআইনি সংস্থার বিরুদ্ধে চার্জশিটে ২৮ জনকে অভিযুক্ত করেছে সিবিআই। সেই তালিকায় বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, ডিএসপি, সিআইডি র আই জি, বেঙ্গালুরু উত্তরের ডিসি সহ একগুচ্ছ পুলিশ অফিসারের নাম রয়েছে ওই চার্জশিটে।আর এই খবরে এখন হতাশ এ রাজ্যের চিট ফান্ডে টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হওয়া সাধারণ মানুষ। তাদের বক্তব্য, যে সিবিআই কর্নাটকে মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই তদন্ত করে এত বড় বড় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়ে দিতে পারল, সেই সিবিআই প্রায় ছ’ বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত চালালেও কেন এ রাজ্যে এখনও অভিযুক্তদের শাস্তির ক্ষেত্রে কোন বড় কোন পদক্ষেপ করা হচ্ছে না?সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় কি বড় কারন, সেই প্রশ্নই উঠেছে। সিবিআইকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর অভিযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় উঠেছে। এবার বেঙ্গালুরুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই অভিযোগ আরো তীব্র হচ্ছে।আই মনিটারি অ্যাডভাইজারি বা আই এম এ কেলেঙ্কারি নিয়ে ২০১৮ সালে বেঙ্গালুরুতে প্রথম জল ঘোলা শুরু হয়। সাধারণ মানুষকে ৩৬ থেকে ৬৪ শতাংশ সুদে প্রলোভন দেখিয়ে ওই সংস্থা বাজার থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেআইনিভাবে তোলে বলে অভিযোগ। ঠিক এ রাজ্যের মতোই সেখানেও সোনা, রিয়েল এস্টেট, স্বাস্থ্য ক্ষেত্র সহ অন্যান্য ব্যবসায় সেই টাকা লাগানোর কথা জানানো হয় সাধারণ মানুষকে।মোহাম্মদ মনসুর খান নামে ওই চিটফান্ড সংস্থার মালিকের পিছনে পুলিশ এবং রাজনীতির প্রভাবশালীদের মদত ছিল বলে অভিযোগ। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে এ ব্যাপারে সতর্ক করে সব তদন্তকারী সংস্থাকে। এরপর ওই অভিযুক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়তে থাকে। অথচ এ বছর জুন মাসে ওই সংস্থা প্রভাবশালীদের কাজে লাগিয়ে তদন্তেই পুলিশ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বলে অভিযোগ। সিবিআইয়ের দেওয়ার চার্জ সিট এ বলা হয়, পুলিশ এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের একটা প্রভাবশালী মহল থেকে ওই সংস্থাকে ক্লিনচিট দিয়ে তদন্ত বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়। অথচ তার পরেও সিবিআই ওই বেআইনি সংস্থা এবং সেখানকার প্রভাবশালী পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে।কেডি সিংয়ের অ্যালকেমিস্ট চিটফান্ড সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। ইতিমধ্যেই কিছু আমানতকারীর টাকা ফেরত দিয়ে হাইকোর্টের রোষানল থেকে কিছুটা ছাড় পেয়েছে এই সংস্থা। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই এখনো এ রাজ্যে কোনো চার্জশিট ফাইল করেনি। অ্যালকেমিস্ট এর আমানতকারীর দের একটি সংগঠনের সম্পাদক বাবলু সাও বলেন, উড়িষ্যায় সিবিআই অ্যালকেমিস্ট এর বিরুদ্ধে তদন্তে যতটা তৎপরতার দেখাচ্ছে, এরাজ্যে ততটা নয়। অথচ একদিকে মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে টাকা ফেরত চাইছেন, একইভাবে অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিও রয়েছে। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থার তরফে সে ব্যাপারে তেমন কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।যে সংস্থার আমানতকারীদের দেখে কলকাতা হাইকোর্ট প্রথম ২০১৫ সালে চিটফান্ডের মামলা শোনার জন্য বিশেষ বেঞ্চ তৈরি করেছিল, সেই এপিএসের আমানতকারীরা এখন হতাশ এতদিন ধরে তদন্ত চালানোর পর মাসখানেক আগে এম পি এস এর বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট পেশ করেছে বটে, কিন্তু আর কোনো অগ্রগতি নেই। এম পি এস এর আমানতকারীদের সংগঠনের পক্ষে কিঞ্জল ভট্টাচার্য বলেন, কিছু দিন আগে প্রায় আড়াই কোটি টাকার সম্পত্তি চুরি হয়ে গেছে ওই সংস্থার। সে ব্যাপারে সিবিআইকে হাইকোর্ট তদন্ত করতে বলেছে। অথচ তদন্তকারী সংস্থার তরফে এখনো কোনো তাপ উত্তাপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, একই তদন্তকারী সংস্থার একই ধরনের মামলায়, বাংলার জন্য একরকম আর কর্নাটকের জন্য অন্যরকম ভাবনা চিন্তা আছে কিনা।এ রাজ্যে চিটফান্ডের আমানতকারীদের পক্ষে মামলার অন্যতম আইনজীবী অরিন্দম দাস বলেন, আমানতকারীদের টাকা ফেরত যেমন অত্যন্ত জরুরী, একইভাবে অভিযুক্তদের সাজার বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই একদিকে মানুষ স্বস্তি পাবে, অন্যদিকে অন্য অপরাধীরাও এতে ভয় পাবে। কিন্তু এ রাজ্যে যে তদন্ত ঢিলেঢালা হচ্ছে, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট বারেবারে প্রশ্ন তুলেছে সিবিআইয়ের তদন্তের গতি প্রকৃতি নিয়ে।সিবিআইয়ের এক অফিসার অবশ্য বলেছেন, তদন্ত ঠিক মতোই এগোচ্ছে। যেখানে যেমন ভাবে প্রয়োজন, ঠিক সেভাবেই কাজ করা হচ্ছে। তবে তার মধ্যে কোথায় পরিকাঠামোগত, কোথাও লোক বল নিয়ে কিছু সমস্যা থেকেই যায়। তাতে কোনো কোনো সময় কিছুটা গতি কম হতে পারে।