রাজনৈতিক সিনেমা বলতে আমরা কি বুঝবো, আদৌ কি কোনো সিনেমা সরাসরি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্যকে চলচ্চিত্রের ভাষায় স্পষ্ট করে বলে যেতে পারে? অর্থাৎ রাজনৈতিক কোনো বক্তব্যকে তর্কে-বিতর্কে, প্রশ্নে-উত্তরে মেলে ধরতে পারে, সমাজ কিংবা শ্রেণি, অর্থনৈতিক বৈষম্য অথবা প্রশাসনের শোষণ-শাসনকে তুলে ধরতে পারে। তবে তো সব সিনেমাই রাজনৈতিক, কারণ প্রায় সব সিনেমাই কোনো না কোনো রাজনীতির ভাবনা অথবা আদর্শে ভর করেই গল্প অথবা বক্তব্য পেশ করে। অথবা যারা তথাকথিত নাচ-গান-হিরো-ভিলেন-সংঘাত-সংঘর্ষ ইত্যাদি ইত্যাদির গল্প এড়িয়ে যান অথবা তারকা সমৃদ্ধ কাহিনির ছায়াছবি তৈরি করেন না বলে দাবি তোলেন তারাও তো সরাসরি না হলেও মেরা ভারত মহানের ভাবাদর্শের রাজনীতিকেই সিনেমায় ফুটিয়ে তোলেন জাতীয়তাবাদী বিশ্বাসে। তাহলে এই সব ছবিকে রাজনৈতিক সিনেমা বলবো না কেন? ভারতীয় অধিকাংশ ছবিই তো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সরাসরি না হলেও পরোক্ষে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকৃষ্ট বিজ্ঞাপন।

তবে এর উল্টোপিঠও রয়েছে। গত শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে উপরিউল্লিখিত ধারাপাতের বাইরে গিয়ে বেশ কয়েকজন ভারতীয় সিনেমা নির্মাতা সমাজ ও রাজনীতি সচেতন সিনেমা তৈরি করতে ব্রতী হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়কে অগ্রগণ্য ধরা হলেও মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, এমএস সথ্যু, গিরীশ কাসরাবল্লি, মনি কাউল, কুমার সাহানি প্রমুখের পাশাপাশি শ্যাম বেনেগালের কথা ভারতীয় ‘সমান্তরাল সিনেমা’র অন্যতম নির্মাতা হিসাবেই উল্লেখ করতে হবে। দীর্ঘ ৯০ বছরের জীবনে ২৪টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের, ৪১টি প্রামাণ্যচিত্র, ৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও ৬টি টেলিভিশন প্রযোজনা যেমন সিনেমার বিপুল সম্ভার পাশাপাশি সেই সম্ভারে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যা হল সমাজ ও রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহ। কিন্তু শ্যামের ব্যক্তিগত আগ্রহ কি শামের ছবিকে পুরোপুরি রাজনৈতিক করেছে, করলে তা কতটুকু কিংবা কোন ধরনের রাজনৈতিক উচ্চারণ?

শ্যামের রুরাল ট্রিলজি বা ‘অঙ্কুর’ (১৯৭৪), ‘নিশান্ত’ (১৯৭৫) ও ‘মন্থন’ (১৯৭৬)-এ আমরা সমষ্টির প্রতিবাদ লক্ষ্য করি, তা অতি বিনয়ের সঙ্গে হলেও ছবি তিনিটির শেষাংশে শ্যাম শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষ নেন একজন অতি নমনীয় বামপন্থায় বিশ্বাসীর মতোই। তাঁর কণ্ঠস্বর শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষ নিলেও সেই প্রতিবাদের মধ্যে ছিল নমনীয়তা। ‘ভূমিকা’ (১৯৭৭) ছবিটি মারাঠি অভিনেত্রী হাঁসা ওয়াদকরের জীবন নির্ভর হওয়ায় নারীর সংগ্রাম যতটা স্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য তেমনভাবে প্রতিফলিত নয়। তবে এটা ঘটনা মার্কসবাদীদের মতো তিনিও সমাজকে শোষক ও শোষিতের শ্রেণিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং ওই দুই শিবিরে বিভাজন করেছেন। সরাসরি প্রথম ছবি ‘অঙ্কুর’-এর কথা বলি। নিম্নবর্ণের লক্ষ্মীর প্রতি জমিদারপুত্র সুরিয়ার যে উদার মনোভাব সেই ভালোমানুষি যে আসলে কামনা চরিতার্থ করতেই তা পরবর্তী সময়ে বোঝা যায়। অত্যাচার ও অবিচারে সেও কম যায় না বলেই লক্ষ্মী তারই কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই নিয়ে কেউ কথা না বললেও বুঝতে কারও অসুবিধা হয়না। লক্ষ্মীর বোবা স্বামী কিশতাইয়া বেকার তার উপর মাদকাসক্ত। একটা কাজ পাওয়ার জন্য সে জমিদারপুত্র সুরিয়ার কাছে যেতেই সে ভেবে নেয় স্ত্রীর গর্ভধারণ নিয়ে সে প্রতিশোধ নিতে এসেছে। সুরিয়া তাকে বেধড়ক মারে। লোক জড়ো হয় কিন্তু তারা বুঝতে পারে। লক্ষ্মী কিন্তু প্রতিবাদ করে এবং জমিদারপুত্রের চোখে চোখ রেখে বলে, আমরা তোমার গোলাম নই, দরকার নেই তোমার কাজ! লক্ষ্মীর প্রতিবাদ উঠানে জড়ো হওয়া গ্রামবাসীর কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়। কেবল তাই নয় লক্ষ্মী, কিশতাইয়া ও গ্রামবাসী যখন চলে যায় তারপর একটি ছোট ছেলে সুরিয়ারে বাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে জানালার কাচ ভেঙে দৌড়ে পালায়। এরপর পর্দা লাল হয়ে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয়না বেনেগাল বিপ্লবের লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এভাবে বিপ্লবের ঝান্ডা ওড়ানো বিপ্লববাদীদেরও ভাল লাগেনা বরং ক্লিষে মনে হয়। গোটা দেশ তো তখন ভূমি সংস্কারের অপেক্ষায় কিন্তু শ্যাম সে বিষয়ে কি ইঙ্গিত করলেন, না তিনি আখ্যানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেই মধ্যবিত্ত দর্শক সমাজকে কোমল, পেলব প্রতিবাদের সিনেমা উপহার দিলেন। যেহেতু সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে তাই তাকে রাজনৈতিক আখ্যায়িত করাও অসুবিধাজনক নয়।

‘নিশান্ত’তেও সামন্তবাদী শাসনব্যবস্থার শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। গ্রামে জমিদারদেরা ত্রাসের রাজত্ব স্থাপন করে যা কেড়ে নিতে ইচ্ছে হয় তাই কেড়ে নেয়, যাকে তুলে নিতে ইচ্ছে করে তুলে নেয়। একদিন গ্রামে বদলি হয়ে আসা মাস্টারের স্ত্রী সুশীলাকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে এবং তাদের বাড়িতেই আটকে রাখে। মাস্টার স্ত্রীকে মুক্ত করতে চায় কিন্তু প্রশাসন জমিদারের হাতের মুঠোয়। গ্রামবাসী ভালোভাবে নেয়না কারণ তারা মাষ্টারকে শ্রদ্ধা করে। একদিন বন্দি সুশীলা তার স্বামীকে বলে, তার জায়গায় সে থাকলে জমিদারের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিত! টনক নড়ে মাস্টারের। সে পুরো গ্রামবাসীকে মূলত দরিদ্র কৃষকদের জমিদারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করে। গণঅভ্যুত্থান ঘটে যেখানে নিহত ও উৎখাত হয় জমিদার ও তার জমিদারি। এমনকি সুশীলাকেও পিটিয়ে মারা হয়। আমরা দেখি অভ্যুত্থানের ঝড়ে লণ্ডভণ্ড জমিদার বাড়ির বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখছে সুশীলার ছোট ছেলে। একসময় ছোট ছেলেটি দৌড়ে চলে যায় মন্দিরে, যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল গ্রামের অন্যান্য ছোট ছেলেমেয়েরা। আর সেখানেই নিশির অন্ত হয়। ‘অঙ্কুর’-এর প্রতিবাদ ছিল একটি ছোট ছেলের আর ‘নিশান্ত’-এ রক্তিম বিপ্লব হয় সদলবলের। ‘অঙ্কুর’-এ গ্রামের মানুষের ক্ষোভ দেখেছিলাম ছোট ছেলের ছোঁড়া ঢিলে ভেঙ্গে পড়ে জানলার কাচ, জনতার ঘৃণা আছড়ে পড়ে অত্যাচারীর উপর, ‘নিশান্ত’-এ একা ছোট বাচ্চা নয় অনেক বাচ্চা।

তেলেঙ্গানা-হায়দরাবাদের সামাজিক অবস্থার পটভূমিতে ‘অঙ্কুর’- এ শ্রেণী সংঘাতের সঙ্গে নারী-পুরুষের আদিম আকর্ষণের বিষয়টি অর্থনৈতিক ও সামাজিক পটভূমির বাস্তব আখ্যান।‘অঙ্কুর’-এ যতটা সামন্ত চরিত্র ফুটে ওঠে, ‘নিশান্ত’-এ তার চেয়ে অনেক বেশি। ছবিতে জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গ্রামের মানুষের ফুঁসে ওঠা যেমন আছে তেমনি অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি আছে নারীদের ওপর নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন, যেটা করলে গ্রামের মানুষ নিঃশব্দে সয়ে যায়। কিন্তু মাস্টারের স্ত্রী সুশীলাকে উদ্ধারের সময় যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, সেখানে বিপ্লবের রীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কারণ কে মরল, কে বাঁচল তার কোনো হিসাব থাকবে না কেন? তাহলে কার জন্য বিপ্লব?

গুজরাটের পটভূমিতে ‘মন্থন’ সমবায় ব্যবস্থাকে তুলে ধরেন শ্যাম। গ্রামে যেখানে একজন ব্যবসায়ী সব বাড়ির গরুর দুধ একাই নিয়ে যায়, এই একচেটিয়া ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যসব কৃষক। তাদের উদ্ধারকল্পে গ্রামে সমবায় ভিত্তিক দুধের খামার গড়ে তোলার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মনোহর রাও নামের এক পশু চিকিৎসককে পাঠানো হয়। শহুরে শিক্ষিত মনোহর অনেকটা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা নিয়ে গ্রামের মানুষদের ভেতর অর্থনৈতিক সংস্কারে ব্রতী হয়। কিন্তু গ্রামে ঋণের জালে জর্জরিত, আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় দলিত শ্রেণি প্রভাবশালী মহাজনের কাছে কম দামে দুধ বিক্রি করে। এই ব্যবস্থাকে পাল্টাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় মনোহরকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা পাল্টায়, মনোহর চলে যাওয়ার পর। কারণ ততদিনে গ্রামবাসীর ভেতর আত্মবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয়ে গিয়েছে। তারা ততদিনে নিজেদের নেতা ভোলাকে পেয়ে গেছে।একসময় গ্রামবাসী লাইন দিয়ে মহাজনের কাছে কম দামেই দুধ বিক্রি করত। ভোলা আহ্বান জানায়, যখন কেউ আস্থা রাখতে পারছিল না, তখন দেখা গেল লাইনের ভেতর থেকে একটি ছোট ছেলে প্রথম বেরিয়ে এলো এবং ভোলাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো। এরপর একে একে সবাই ভোলার পিছু নেয়। ভোলা সবাইকে উজ্জীবিত করে যে, তারা নিজেরা সমবায় সমিতি চালাতে পারবে, এভাবে ঠকে আর দুধ বিক্রি করতে হবে না। এই ছবি তৈরি হয়েছিল ভারতের মিল্ক ম্যান ভার্গিস কুরিয়ানকে নিয়ে। ভাবতে অবাক লাগে, এই ছবির জন্য ৫ লক্ষ গোয়ালা দিয়েছিলেন ২ টাকা করে। সেই টাকায় তৈরি হয়েছিল ছবি। যা ইতিহাস।
