মানুষের আভিজাত্য প্রকাশ পায় বাড়ির সৌন্দর্য্য আর বিলাসিতায়। তবে এমন শহরও রয়েছে যেখানে বাড়ি তৈরি হয় মাটি দিয়ে। এমনকি বহুতল ভবন তৈরির উপকরণও মাটি। একসময় আমাদের দেশের অধিকাংশ গ্রামে মাটির তৈরি বাড়ি চোখে পরত। যেটা শত শত বছর ধরে সেই গ্রামগুলির ঐতিহ্য বহন করত। যদিও এখন আর তেমন মাটির বাড়ি দেখা যায় না। তার বদলে সেখানে জায়গা নিয়েছে ইট পাথরের বাড়ি। তবে ইয়েমেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত হাদরামাউত উপত্যকার এক বিস্ময়কর শহর শিবাম। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন উঁচু ভবনের নগরী, যেখানে সমস্ত বহুতল বাড়িগুলি কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি। এই কারণে একে ‘মরুভূমির ম্যানহাটন’ বা ‘পৃথিবীর প্রথম উঁচু ভবনবিশিষ্ট শহর’ বলা হয়। শিবামের স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণপ্রক্রিয়া, ইতিহাস ও টিকে থাকার রহস্য সত্যি অনন্য। সাত থেকে আট হাজার মানুষের বাস এই শহরে। তবে এই শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব হল এই শহরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা যেগুলি ইট, সিমেন্ট, লোহা বা কংক্রিটের তৈরি নয়, রোদে শুকনো মাটির ইট দিয়ে তৈরি করা। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে ইয়েমেনের এই অঞ্চলটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ার ফলে এই অঞ্চল ঘিরে ইয়েমেনের আশেপাশের মানুষদের আগ্রহ বেড়ে যায়। পাশাপাশি এখানকার অধিবাসীরাও ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে থাকে।
শহরটিতে ৫০০-র বেশি বাড়ি রয়েছে, যেগুলির উচ্চতা ৫ তলা থেকে ১১ তলা পর্যন্ত এবং অনেকটা এখনকার ফ্ল্যাট বাড়ির আদলেই তৈরি। তবে পার্থক্য একটাই, বিশাল বিশাল বাড়িগুলি একটি পরিবারের জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। বাড়িগুলির কয়েকটি তলা আবার পৃথক পৃথক কাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকত। যেমন নীচের তলা বাসস্থানের জন্যে, যেহেতু পশুপাখি পালন করা তাদের জীবিকা ছিল তাই নীচের তলা ব্যবহার করা হত গৃহপালিত পশুপাখি রাখার জন্য। ২য় তলাটি অনেক সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বা দোকান বা অফিসের কাজে ব্যবহার করা হত। আর তার জন্যই ১ম ও ২য় তলায় কোনো জানালা রাখা হত না। বাড়ির বাসিন্দারা বাস করত ৩য় তলা থেকে। বাড়ির প্রতি তলায় পৃথক থাকার ব্যবস্থা থাকত। বাচ্চাদের জন্য আলাদা, স্বামী-স্ত্রীর জন্য আলাদা অথবা পরিবারের একত্রে সময় কাটানোর জন্যে আলাদা, এমনকি অতিথির জন্যে আলাদা তলার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে পরিবারগুলো ভাগ হতে হতে পুরো বাড়িও বিভিন্ন অংশে ভাগ হতে থাকে। তাই এখন একেকটি তলা একেকটি পরিবারের দখলে রয়েছে। শিবামের মাটির তৈরি ঘরগুলির উচ্চতা অন্য যেকোনো জায়গার মাটির ঘরের তুলনায় বেশি। বাড়িগুলি প্রায় ৪৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে।
একের পর এক ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি হত বিশাল বিশাল দেওয়াল। প্রতিটি তলায় কাঠের ছাদ ব্যবহার করা হত। তবে বাড়ি বানানো হয়ে গেলেও এর রক্ষণাবেক্ষণে কম ঝক্কি পোহাতে হয় না। প্রতিবছর বর্ষায় অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাড়িগুলির বাইরের দেওয়ালে নিয়মিত চুনকাম করতে হত। দেওয়ালে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হলে মাটির মিশ্রণ দিয়ে এক ধরনের প্রলেপ দেওয়া হত। ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই বলে হাজার বছর বেশ স্বচ্ছন্দেই টিকে রয়েছে বিশাল এই বাড়িগুলি। ১৯৮২ সালে ইউনেস্কোর নজরে আসে শহরটির স্থাপত্যশৈলী। তাদের মতে, ঐতিহাসিকভাবে এত প্রাচীন ঘরবাড়ি আর কোথাও নেই। সেই বছর ইউনেস্কো শহরটিকে বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে নথিভূক্ত করে। ফলে বিশ্বের অনেক পর্যটকের নজর কাড়ে স্থানটি। কিন্তু পরবর্তীতে নিরাপত্তার অভাবে জায়গাটি পর্যটনের গুরুত্ব হারাতে থাকে। তাছাড়া ভৌগলিক কারণে শিবাম শহরটি বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশ কয়েকটি বন্যার কারণে শিবামের অনেকগুলি বাড়ি বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। নতুন করে আর আগের মতো বাড়ি বানানো সম্ভব হয় না। ফলে একসময় হয়ত হারিয়ে যেতে পারে হাজার বছরের মধ্যপ্রাচ্যের এই অভাবনীয় প্রাচীন নিদর্শনগুলি।
তা স্বত্বেও শিবামের পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে শহরটির চারপাশের অপরূপ স্থাপত্যশৈলী যে কোনো পর্যটককে ভাবতে বাধ্য করে হাজার হাজার বছর আগের সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাস। অনেক মানুষের চেষ্টা ও স্থাপত্য কৌশলী এখনো যে কাউকে অবাক করে তোলে পরম বিস্ময়ে। কিন্তু উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া হয়ত একদিন হারিয়ে যাবে বহু বছর আগের তৈরি এই অসাধারণ কীর্তি।