জনসংখ্যার চাপে ১৮৮২ ও পরবর্তী লন্ডনের অবস্থা হয়ে পড়েছিল খুবই শোচনীয়। তখন পূর্ব ইউরোপ থেকে ইহুদীরা লন্ডনে ভীড় জমায়। জনসংখ্যার তুলনায় চাকরির সংখ্যা না বাড়ায় অপরাধের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। প্রায় প্রতিদিন চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির মতো অপরাধ লেগেই থাকতো। পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকাতে তখন ছিল ৬২টি নিষিদ্ধপল্লি যেখানে পতিতার সংখ্যা ছিল ১২০০!
১৮৮৮ সালের ৩১ অগস্ট ভোরবেলা লন্ডনের রাস্তায় টহল দিতে বেরিয়ে পুলিশ একটি রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে যার গলাকাটা ধারালো কোনও অস্ত্রের নিখুঁত টানে। পরে দেখা যায় তলপেটেও গভীর ক্ষত৷ জানা যায়, নিহত মেরি অ্যান নিকলস হোয়াইট চ্যাপেল এলাকার নিষিদ্ধপল্লির পতিতা। প্রথমে তার গলা কেটে খুন,তারপর তলপেট কেটে বের করে নেওয়া হয় তাঁর জরায়ু৷ এমন নৃশংস খুনে পুলিশও চমকে উঠেছিল৷

কিন্তু চমক কেটে যায় আট দিনের মাথায়। লন্ডনের রাস্তা থেকে পুলিশ ফের উদ্ধার করে গলা ও পেট ফালা করে কাটা একটি দেহ উদ্ধার হওয়ায়। এবারও নিহত অ্যানি চ্যাপম্যান একই এলাকার পতিতা। সেদিন ভোর ছ’টা নাগাদ উদ্ধার হওয়া চ্যাপম্যানকে মৃত্যুর আধ ঘণ্টা আগেও নাকি কালো চুলের এক ‘ভদ্র চেহারার’ মানুষের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল৷ খোদ লন্ডন শহরে সাত দিন আগে পরে পর পর দু’টি হত্যাকাণ্ড পুলিশের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। তার থেকে বেশি চিন্তার খুনির অস্ত্র চালানোর দক্ষতায়। সে যে সূক্ষতায় গলা এবং তলপেট ফালা করে তা কেবল দক্ষ হাতের টান নয়, খুনি চিকিত্সা বিদ্যায় পারদর্শি হতে পারে। এমন খুনির সন্ধানে তোলপাড় হল লন্ডন৷
কিন্তু খুনির সন্ধান পাওয়া তো দুরের কথা ২২ দিন পর কয়েক ঘণ্টার ফারাকে উদ্ধার হল এলিজাবেথ স্ট্রাইড ও ক্যাথেরিন এডোজ নামে আরও দুই পতিতার লাশ৷ খুনের ধরনও সেই আগের মতো তবে আরও ভয়াবহ। এছাড়া উদ্ধার হয় মেরি জেন কেলির দেহ তাঁর নিজের ঘরের বিছানা থেকে। তাঁর পেট ফালা করে ভেতরের প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বের করে নেওয়া হয়েছে, এমনকি হৃদপিণ্ডটিও।

স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড লন্ডন শহরে এমন ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করতে পারে না। তাদের সন্দেহের তালিকায় সব চেয়ে উপরের দিকে যে তিন জনের নাম ছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম অ্যারন কসমিনস্কি। পোল্যান্ডের বাসিন্দা সেই ইহুদি পেশায় ছিল ‘হেয়ারড্রেসার’। জানা যায়, অ্যারন ‘প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া’ আক্রান্ত, তারই জেরে অনেক সময় সে নিজেকেও যৌন নির্যাতন করত। সম্ভবত সেই বিকৃত কামের তাড়না মেটাতে সে বেছে বেছে যৌনকর্মীদেরই হত্যা করে। প্রথম কোপে গলার নলি ফাঁক, তার পর তাদের পেট চিরে কারও জরায়ু, কারও কিডনি বের করে নেওয়ার মতো নৃশংসতা তাকে পেয়ে বসেছিল।

লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ২০০০ মানুষকে জেরা করে, ৩০০ লোককে নিয়ে তদন্ত হয়, ৮০জনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেই সিরিয়াল কিলারের নাগাল পায়নি। তবে তারা নিশ্চিত করে যে সেই খুনি জ্যাক দ্য রিপার (JACK THE REAPER )। তখন থেকে জ্যাক দ্য রিপার-কে নিয়ে অনেক গল্প শুরু হয়। পুলিশ জ্যাক দ্য রিপারকে নিয়ে অসংখ্য চিঠি পেতে থাকে। চিঠিপ্রেরক নিজেই খুনী এমন চিঠিও আসতো। একটি চিঠির নিচে প্রেরক সই করেছিল জ্যাক দ্য রিপার নাম দিয়ে। তবে বিশেষজ্ঞরা এক মত ছিল যে, জ্যাক দ্য রিপার পেশায় ডাক্তার ছিল, কারণ সে যতটা নিখুঁতভাবে গলা, তলপেট কাটতো এবং পেটের ভেতরের অঙ্গগুলো কেটে বার করতো তা একজন চিকিৎসকের পক্ষেই সম্ভব। সে কখনও উইকেন্ড ছাড়া খুন করেনি!

তবে একই এলাকায় এমা স্মিথ আর মার্থা ট্যাব্রাম খুন হলেও তাদের খুন হওয়ার ধরণের সঙ্গে জ্যাক দ্য রিপারের ধরণ না মেলায় তাদের খুনকে সিরিয়াল কিলিং- এর অংশ হিসেবে ধরা হয়নি। এবং ওই দুটি খুনও আলোচিত পাঁচটি খুনেরও আগে হয়। জ্যাক দ্য রিপারের কীর্তিতে মোট এগারোটি খুনের কথা লেখা আছে। এর মধ্যে প্রথম পাঁচটিকে ক্যানোনিকাল ফাইভ বলা হয় আর জ্যাক দ্য রিপারের উপর গবেষণাকে বলা হয় “রিপারোলজি”।
লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ‘সিরিয়াল কিলারের’জ্যাক দ্য রিপারের হদিশ না পেলেও ১২৬ বছর পর সেই কুখ্যাত খুনির পরিচয় জানা যায়। শতাব্দী-প্রাচীন রিপারকে যেভাবে চেনা যায় সেও প্রায় এক অবিশ্বাস্য কাহিনি। যার নেপথ্যে রয়েছে একটি শাল। এবং অবশ্যই তা আলাদা ভাবে বলার দাবি করে।
2 Comments
খুবই নৃশংস বিষয়, কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় খুনির কারণে, স্কটল্যান্ড ইয়র্ড ডাহা ফেল করল
জ্যাক দ্য রিপার কোথা থেকে কিভাবে এল আর গেল সেসব কি বিস্তারিত জানা গিয়েছিল…?