কলকাতা ব্যুরো: শিক্ষক দিবস কবে জানেন? শিশু দিবস কবে বলতে পারবেন? আচ্ছা, বড়দিনের উৎসব কবে পালিত হয়? জানি, আপনারা বলবেন ৫ সেপ্টেম্বর ১৪ নভেম্বর আর ২৫ ডিসেম্বরের কথা। কিন্তু আপনাদের এই তথ্য সারা দেশ বা বিশ্ব জানলেও রাজ্যের কিছু বেসরকারি স্কুল কিন্তু তা জানে না, বা মানে না।এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে লকডাউনের মধ্যে জুলাই মাস পর্যন্ত রাজ্যের বেশ কিছু বেসরকারি স্কুল মহা ধুমধামের সঙ্গে এই তিনটে দিন পালন করেছে। অবশ্যই খাতায় কলমে। মোটা টাকা খরচ দেখানো হিয়েছে সেই বাবদ।কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে বেসরকারি স্কুলগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে যে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছিল, আদালত নিযুক্ত সেই কমিটির কাছে এমনই চমকপ্রদ তথ্য জমা পড়েছে। যা দেখে বিস্মিত দুই সদস্যের কমিটির অন্যতম, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস ও শিক্ষাবিদ গোপা দত্ত।কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে স্কুল গুলির আয়-ব্যয়ের খতিয়ান দেখতে গিয়ে ওই কমিটি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যে তিনদিন উৎসব পালনের কথা বলা হয়েছে, আমরা নিশ্চিত জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে এই তিনটি বিশেষ দিন পরে না।প্রশ্ন। তাহলে কেন এমনটা করা হলো? উত্তর একটাই, গল্পের গরু গাছে চড়ার যে প্রবাদ রয়েছে, তাই বাস্তবে করে দেখিয়ে দিয়েছে রাজ্যের বেশকিছু বেসরকারি স্কুল।আয়-ব্যয়ের হিসাব কমিটিতে জানাতে গিয়ে একদিকে তারা যেমন বলেছে জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে তারা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষামূলক ভ্রমণে গিয়েছে আবার তেমনি স্কুলের কর্মীদের পিকনিক নাকি করা হয়েছে এই সাত মাসের মধ্যেই।একদিকে স্কুল যে খরচের হিসাব দিয়েছে সেখানে যেমন এই খাতে মোটা টাকা খরচ দেখানো হয়েছে, তেমনি বিস্ময়করভাবেই জেনে রাখুন, আপনার কষ্টার্জিত টাকা তারমানে পড়াশোনার জন্য নয়, স্কুলের শিক্ষক শিক্ষা কর্মীদের মোচ্ছব এর জন্য আপনি দিয়ে থাকেন। আবার এক্সকার্শন বা শিক্ষামূলক ভ্রমণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হয় তারাই তার খরচ বহন করে থাকে বলে এতদিন জানা ছিল, কিন্তু এ রাজ্যে গজিয়ে ওঠা কিছু বেসরকারি স্কুলের তথ্য বলছে, তা নয়, শিক্ষামূলক ভ্রমণে যারাই যাবেন তাদের খরচ দিচ্ছে গোটা স্কুল। আপনি ভাবতেই পারেন তা কি হয়!সত্যি-মিথ্যে যাই হোক না কেন, হাইকোর্টের নির্দেশে রীতিমতো হলফনামায় স্বাক্ষর করে সেই সব হিসেব কমিটির কাছে তুলে দিয়েছেন স্কুলের অধ্যক্ষ বা প্রধান। পাশাপাশি যে চাটার্ড একাউন্টেন্ট ওই হিসেবে রাখেন তিনিও তাতে স্বাক্ষর করেছেন। ফলে তা মিথ্যে বলার কোনো অধিকার নেই।হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও স্কুলগুলির অনেকেই খুব একটা তাতে হেলদোল দেখায়নি তা স্পষ্ট কমিটির রিপোর্ট। কমিটির বক্তব্য, প্রতিমাসের হিসেব ভেঙে ভেঙে দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে বহু ক্ষেত্রেই তা দেওয়া হয়নি। আর তাই সুরঞ্জন দাস এর কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, আদালত যে দায়িত্ব তাদের পালন করতে বলেছিলেন, এমন ত্রুটিপূর্ণ হিসেব দেওয়া হলে তাদের পক্ষে তা করা অসম্ভব।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস ও শিক্ষাবিদ গোপা দত্ত সুপারিশ কমিটির বক্তব্য, বিভিন্ন খাতে যেভাবে বিশাল অংকের টাকা নেওয়া হয়েছে অথচ সেই বাবদ খরচ হয়নি, আদালত যদি মনে করে, অভিভাবকদের চাপ কমাতে ফি কমানোর কথা ভাববে, সে ক্ষেত্রে এই দিকে নজর দিতে পারে হাইকোর্ট।
লকডাউন এর পরে স্কুলগুলির ফি কমানো নিয়ে হাইকোর্টে দায়ের হওয়া মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল, যেসব ক্ষেত্রে সার্ভিস দেওয়া হয়নি, তেমন বহু ক্ষেত্রেই স্কুল গুলি চার্জ নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে দিতে গিয়ে কমিটি প্রশ্ন তুলেছে, লকডাউনের মধ্যে অশিক্ষক কর্মীদের বেতন দেওয়ার খাতে খরচ দেখানো হয়েছে আবার একই সঙ্গে স্কুলের বাস গাড়ির খরচ হয়েছে বলেও হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কমিটির প্রশ্ন যদি গাড়ির চালক এবং খালাসী অশিক্ষক কর্মী হিসেবে বেতন পেয়ে থাকেন, তাহলে লকডাউনের মধ্যে বসে থাকা গাড়ির গুলিতে কিসের জন্য খরচ হয়েছে? যথারীতি তার কোন ব্যাখ্যা নেই স্কুলগুলির দেওয়া রিপোর্টে।প্রায় সব স্কুলই বলেছে, লকডাউনের মধ্যে তারা অনলাইনে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছে। কিন্তু কমিটির প্রশ্ন, লকডাউন কবে থেকে হয়েছে আর কবে থেকেই বা কোন স্কুলে পড়াশোনা করিয়েছে তার কোনো তথ্য দেওয়া নেই। সেখানে বিভিন্ন নামে স্কুল গুলি পরীক্ষার মোটা টাকা ফি নিয়েছে। কমিটির প্রশ্ন যে টাকা পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে না থাকলেও, এত টাকা পরীক্ষার খরচ করেছে স্কুলগুলো?
কমিটি দেখেছে এই সময়ের মধ্যে স্কুলগুলো দান ধ্যান প্রচুর করেছে। অন্তত তারা হিসেব তাই দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কমিউনিটি মেনটেনেন্স, ডোনেশন এন্ড কন্ট্রিবিউশন, স্কুল ইন্টার ব্রাঞ্চ মিটিং এক্সপেন্সেস, কন্ত্রিবিউশন ফর সাপোর্ট টু এডুকেশন, চ্যারিটি ফর লিটারেসি প্রোগ্রাম, স্টুডেন্ট রিলেটেড এক্সপেন্ডিচার, স্টাফ পিকনিক, হাউসকিপিং স্কুল রানিং এক্সপেন্সেস, ম্যানেজমেন্ট এক্সপেন্সেস, এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কস এক্সপেন্সেস, এডুকেশনাল অ্যাক্টিভিটি প্রজেক্ট এক্সপেন্সেস, পেন্ট্রি এক্সপেন্সেস, সাইন্স অর হোম সাইন্স অর টাইপিং চার্জ টাও নিয়েছে লকডাউন এর মধ্যে স্কুল গুলি। কমিটি বিস্মিত, এতকিছু ফি নিলেও, কোন মাসে কত টাকা নিয়েছে, তার বিস্তারিত রিপোর্ট প্ৰাই কেউই কিন্তু দেয়নি। তাই কমিটির নির্দেশ, আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসেব না দিলে লকডাউনের মধ্যে কি পরিস্থিতি হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। এমনকি স্কুল বন্ধ থাকা কালিন যে ফি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে তা নেওয়া অযৌক্তিক বলেই মনে করছে কমিটি। যদিও বারেবারেই কমিটি যে প্রশ্ন তুলেছে তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট, বিভিন্ন খাতে আয় এবং ব্যয় দেখানো হলেও আদবে বিস্তারিত রিপোর্ট না দিয়ে পুরো বিষয়টাই গুলিয়ে দিতে চেয়েছে বেসরকারি স্কুলগুলোর একাংশ।শুধু তো খরচের হিসাব নয়, আপনি জানলে অবাক হবেন যে লকডাউন এর মধ্যেও আপনি স্কুলের ডেভলপমেন্ট ফি দিয়েছেন। কম্পিউটার ফ্রি দিয়েছেন। পিরিওডিক সেকে সনাল ফি দিয়েছেন। সিজনাল চার্জ দিয়েছেন। কম্পিউটার অথবা বায়োলজি ফি দিয়েছেন। কম্পিউটার চার্জ দিয়েছেন। চার্জ দিয়েছেন ইউনিফর্ম এবং বেল্ট এর জন্য।আপনি কিন্তু টাকা দিয়েছেন স্কুলকে বা বলা যায় স্কুল আপনার থেকে ওই বাবদ টাকা নিয়েছে অন্তত কমিটির কাছে জমা পড়া রিপোর্ট তাই বলছে। একইসঙ্গে স্কুল চলুক না চলুক, করোনার ভয়ে মানুষ আতঙ্কে ঘরে বন্ধ যতই হয়ে থাক না কেন, বেসরকারি স্কুল গুলো কিন্তু দায়িত্ব জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে এই সময়ের মধ্যে প্রশাসনিক ফি নিয়েছে, মেনটেনেন্স চার্জ নিয়েছে, হোস্টেল থেকে ইনকাম দেখিয়েছে, টিচিং এইডস অন্ড প্রজেক্ট বাবদ আয় করেছে। এক্সকার্শন থেকে আয় করেছে, স্মার্ট ক্লাস ফি – তাতেও স্কুলকে আপনি টাকা দিয়েছেন। টাকা দিয়েছেন মেডিকেল ফি বাবদও।