পরিবেশ দূষণ, উষ্ণায়ন যখন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে তখন প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধ করতে এক অভিনব রাস্তা খুঁজে নিয়েছে একটি স্কুল। জে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বেতন হিসেবে কোনো টাকা দিতে হয় না। পরিবর্তে স্কুলে জমা দিতে হয় প্লাস্টিকের বর্জ্য। প্রতিদিন সকালবেলায় ছাত্রছাত্রীরা প্লাস্টিক বর্জ্যের একটি ব্যাগ হাতে নিয়ে স্কুলে যায়। আর সেই প্লাস্টিক বর্জ্যের বিনিময়েই তাদের স্কুলের পাঠ দেওয়া হয়। মাজিন মুখতার ও তার স্ত্রী পারমিতা সারমার প্রতিষ্ঠিত এই সাক্ষরতা বিদ্যালয় ব্যবহৃত প্লাস্টিক পোড়ানো বন্ধের বিনিময়ে স্কুলের বেতন মুকুফ করে ছত্রছাত্রীদের পরিবেশ সচেতন করে তুলছেন।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের গুয়াহাটি থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে পামোহিতে গাছপালা ঘেরা এই স্কুলের নাম অক্ষর। পারমিতা শর্মা এবং মজিন মুখতার ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই স্কুল। তাঁদের কথা, তাঁরা চেয়েছিলেন এমন একটি স্কুল তৈরি করতে যেখানে গড়পড়তা শিক্ষার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের নানা বিষয়ে উৎসাহী করতে। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তাঁরা বেছে নেন প্লাস্টিক দূষণ রোধ। একটা সময় এই এলাকায় পোড়া প্লাস্টিকের গন্ধে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠত। এখানকার মানুষ ব্যবহার করা প্লাস্টিক পোড়াত। এতে বিষাক্ত ধোঁয়ায় ছেয়ে যেত গোটা এলাকা। সেইসব দেখেই তাঁরা একটা স্কুল গড়ার কাজ শুরু করেন।

পামোহির অধিকাংশ মানুষ খুবই গরিব। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ পাথর কাটার কাজ করে। কেউ কেউ চা বাগানে কাজ করে। যে কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো তাদের কাছে বিলাসিতা। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে বাবা মায়েরা বাচ্চাদের পড়াশোনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়। ২০১৬ সালে যখন স্কুলটি তৈরি হয় তখন শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১৫ জন। গ্রামটির বেশিরভাগ শিশু স্থানীয় পাথর কোয়ারিতে কাজ করে প্রতিদিন উপার্জন করতো। এই জন্য খুব কম বাবা-মা তাদের পরিবারের একজন রোজগার করা বাচ্চাকে উপার্জনক্ষম স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন। এরপর স্কুল-চালকেরা বাচ্চাদের বাবা-মাকে তাদের বাচ্চার সঙ্গে পরিবারের ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলি পাঠাতে বলেন, কিন্তু তারা সেটাও করেনি। তারা বাড়িতে প্লাস্টিক পোড়াতেই পছন্দ করতেন। তখন স্কুল চালকেরা জানান, প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে স্কুলে এলে আর স্কুলের বেতন মুকুফ হয়ে যাবে। এরপর থেকে গোটা ছবিটা পাল্টে যেতে শুরু করে। স্কুলের বেতনের বিকল্প নীতিটির ফলে পরিবারগুলিতে প্লাস্টিক জ্বালানো বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা প্লাস্টিক জ্বালানো বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষরও করেন।

এই স্কুলে সিলেবাস শেষ করার তাড়া নেই, শিক্ষক-শিক্ষিকার চোখ রাঙানি নেই। পড়াশোনার ধরন একেবারেই আধুনিক। পাঠ্য বইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের অন্যান্য বিষয়েও এখানে পাঠ দেওয়া হয়। স্কুলটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণও দেয়। তার কীভাবে সৌর প্যানেল স্থাপন করতে পারে এবং শিপিং ও ইলেকট্রনিক্স ওয়ার্কশপে অংশ নিতে পারে- তা শেখানো হয়। কিন্তু পড়াশোনা করতে কোনো টাকা লাগে না। বেতন হিসেবে জমা দিতে হয় প্লাস্টিক। ভাঙাচোরা, চ্যাপ্টা, থ্যাবড়ানো যে কোনো ধরনের ২৫টি প্লাস্টিকের বোতল প্রতি সপ্তাহে স্কুলে জমা দিতে হয়। সপ্তাহে যত প্লাস্টিক জমা হয়, স্কুলে সেগুলো দিয়ে ইকো-ব্রিক তৈরি করা হয়। বাচ্চারা এই ইকো-ব্রিক স্কুলেই তৈরি করে। একটা প্লাস্টিকের বোতলের ভেতরে অন্তত ৪০টি প্লাস্টিক বর্জ্য ঠেসে মুখ বন্ধ করে তৈরি করা হয় এই ইকো-ব্রিক। সেই বোতল বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যায়। বাড়ি তৈরিতে বা কোনো নির্মাণকাজে ইটের বদলে পরিবেশবান্ধব এই ইকো-ব্রিক ব্যবহার করলে ইটভাটার দূষণও রোধ করা যায়।

স্কুল প্রতিষ্ঠাতা আফ্রিকান-আমেরিকান মুখতার আসামের একটি স্কুল প্রকল্পে কাজ করতে ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক থেকে ভারতে এসেছিলেন। এরপর গোয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্রী সারমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০১৬ সালে এই দম্পতি সাক্ষরতা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যালয়টি পরিচালনার জন্য তারা দাতব্যসংস্থা থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন। ১৫টি বাচ্চা নিয়ে শুরু হওয়া সাক্ষরতা স্কুলটিতে এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী এই সব বাচ্চাদের পড়ালেখার জন্য ৭ জন শিক্ষক আছেন। জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ২৫ ইউনিট প্লাস্টিক সংগ্রহ হয়। এর মাধ্যমে প্রতি মাসে ১০ হাজারেরও বেশি প্লাস্টিক টুকরা সংগ্রহ হয়। এগুলো পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এখন প্লাস্টিক পোড়ানো অনেকখানি কমে গেছে। যেখানে আগে প্লাস্টিক পোড়ানো ধোঁয়ার মেঘে প্রায়শই স্কুল এলাকা ঢেকে যেতো।

এর মধ্য দিয়ে যেমন শিশুশ্রম অনেকটা নিরসন হয় তেমনি পিয়ার-টু-পিয়ার লার্নিং মডেল তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে একটু বেশি বয়সী বাচ্চারা তাদের চেয়ে কম বয়সীদের শেখায় এবং তার বিনিময়ে তারা টাকা পায়। গত কয়েক বছরে কেউ স্কুলছুট হয়নি। বাচ্চারা এখন আরও সচেতন। তারা জানে প্লাস্টিক তাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে এই ক্ষতিকর প্রভাবগুলো নিয়ে আলোচনা করে। তারা আশেপাশের মানুষকে সচেতন করে তুলছে।
