নিঃশেষিত রক্তপলাশের শোকে “প্রহর শেষের আলোয় রাঙা” সর্বনাশা মাস মিলিয়ে যেতেই, দিগন্তে ঘাপটি মেরে থাকা ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’ নিদাঘ দুপুরের বাহুতে আছড়ে পড়ে। মেঘ-রোদ্দুরের কাটাকুটিতে থমকে দাঁড়ায় হলুদ সময়। ডাহুক-পানকৌড়ির বিস্ময়ের ডানায় উছলে ওঠে, মরচে ধরা মুহূর্তের ঘোর।
মন কেমনের কানায় কানায় অবুঝ আকুতি এসে খড়কুটোময় বাসা বাঁধে। ভরা এই ১লা বৈশাখে, নদীবাঁকের কথকতা একলাই, স্মৃতির অতলে ডুবে থাকা চেনা সংলাপগুলো বিড়বিড় করে বলে চলে! শুকিয়ে যাওয়া নদীচরের অবিন্যস্ত নুড়িপাথরগুলোর উনুপাঁজরে জমে থাকা শিশিরের জল, ঢলে পড়ে আলোআঁধারি জ্যোৎস্নার কোলে।

সেই যেখানে ধোঁয়া ধোঁয়া নীল পাহাড়, আগলে রাখে দিগন্ত। নুড়িপাথরের অনর্গল কলতানে, উছলে ওঠে আনন্দ। রঙ-বেরঙের প্রজাপতির পাখায়, চলকে পড়ে বসন্ত। সেই যেখানে পাহাড়ি আবেগের খাঁজে খাঁজে, ঝুলে থাকে সারি সারি অভিমানী মেঘ। তুমুল বৃষ্টি হলে মুহূর্তে গলে যাবে জানি যতো মান-অভিমান, আর গুম হয়ে থাকা সব ক্লেদ। নিঃসীম শুন্যতা বুকে বয়ে তবু চেয়ে আছে, বক্ষছেদি অরণ্য মাঝে ধ্বস্ত সভ্যতার পাঁজরের হাড়। রক্তপাতে ডুবে যাওয়া অভিমানী সূর্যের আভায়, কখন যেন খুলে যায় প্রতীক্ষার সিংহদুয়ার!
অন্ধকারেরা সুযোগ বুঝে ঝুপ করে নেমে আসে বন্য সন্ধ্যার আবদারে। দূর থেকে ভেসে আসা ময়ূরের ডাকে আবছায়ারাও শরীর লুকোয়। মেঘেরা কেবলই চলকে ওঠে পাহাড়ের আহ্ললাদি আঁচল ছুঁয়ে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে বন-পাহাড়ির গাল বেয়ে। কুয়াশার মতো ছেয়ে ফেলে তাঁরা … জঙ্গলের আদিমতার আশকারায় সঞ্চিত থাকা জল-রঙা কাঁচফুলগুলো। দমকা হাওয়ার উচ্ছ্বাসে আচমকাই খুলে যায়, আধেক-লীন সেই কবেকার মায়া পথগুলো।

কোন এক বৈশাখী কাকভোরে, ঝাঁক ঝাঁক রোদ্দুর এসে প্রথম ছুঁয়েছিল আমার মিটিমিটি চোখের পাতা। কোন এক আলোআঁধারি বৈশাখী বাঁকে, ভরসার কোঠরে বাসা বেঁধেছিল আশ্চর্য এক দুর্মর ভালোবাসা। কোন এক উথালপাতাল বৈশাখী বিকেলে, কবিতা বোঝাই খাতা হাতে গুঁজে দিয়ে, পাতা ঝরা হেমন্ত সন্ধ্যার কাছে ঋণভারটুকু জমা রেখে ফিরে এসেছিলাম। কোন এক আবেগ বোঝাই বৈশাখী রাতদুপুরে, উদ্দাম রক্তস্রোতের প্লাবনে, বানভাসি হৃদয় ভাসিয়ে ছিলাম কালের ঠিকানায়।
তার পর… অবিকল সেই প্লাবনের অপেক্ষায় কতদিন ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম জন্মান্তরি নদীর উতলা বক্ষ মাঝে। অরণ্যের আদিমতার আলিঙ্গনে। থইথই জ্যোৎস্নার উচ্ছ্বাস উজাড় করে দেবো বলে। কিন্তু প্রতীক্ষার সেই রাতের আকাশ ফুঁড়ে একফালি চাঁদও উঁকি মারেনি! নুড়িপাথরের ঠোকাঠুকিতে লেগে থাকা রক্তের দাগ কতবার মুছতে গিয়েও, তবু মুছে ফেলা আর হয়নি!

তারপর কত কৃষ্ণচূড়ার আলো ঝলসানো নিদাঘ দুপুর, কত জ্যোৎস্না ধোয়া মায়াবী সন্ধ্যা, কত আলাপী নিশিযাপন পার হয়ে, আজ এসে থমকে দাঁড়িয়েছি নীল পাহাড়ের পাঁজরে জড়িয়ে থাকা খাদের কিনারায়। ঝাঁক ঝাঁক আবেগ বুকে বয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে দুরন্ত জলপ্রপাত। দূর আকাশের মিটিমিটি তারার মতো, আজও ধিকিধিকি জ্বলে আছে নির্জন ইষ্টিশনের পরিত্যক্ত লন্ঠন।
স্মৃতির জলফড়িঙের মতো ভাসতে ভাসতে এতদিনে সত্যি ভুলে গেছি ঝলমলে রোদ্দুরের জমকালো আবেদন। বল্গাহীন বৃষ্টি ধারায় গলে পড়া কাজল-লতার কবেকার সেই উচ্ছল আলিঙ্গন। সেই টলোমলো চোখ। ছলছল ঠোঁট। টোল পড়া গাল। বৃষ্টিস্নাত সাত সকাল। ভুলে গেছি … সঅঅঅব!!! এই আমি আর সেই আমি-র মধ্যে অন্তহীন ব্যবধান গড়ে দেয় অমোঘ সময়।

আজ, এই কাঁচাপাকা চুলের এলোমেলো উদভ্রান্তির খাঁজে খাঁজে, দিকভ্রান্ত মধুমাসের সাতকাহনগুলো ফিরে ফিরে উঁকি মারে। স্পষ্ট কানে বাজে, অবুঝ নদীর বুক উজাড় করে ছড়িয়ে থাকা নুড়িপাথরের ঠোকাঠুকির শব্দ। আদিগন্ত পাহাড় টপকে নক্ষত্র গলে পড়ার শব্দ। মন কেমনের নদীর পাড় ভাঙার শব্দ। আঁতুড় ঘরের নাড়ি কাটার শব্দ।
ঢলে পড়া রোদ্দুরের অন্তরের অন্তহীন উদভ্রান্তি ঠাওর করে জীবনানন্দও মুচকি হেসে ফেলেন … “মাটির পৃথিবীর টানে মানব জন্মের ঘরে কখন এসেছি / না এলেই ভালো হতো এই অনুভব করে / এসে যে গভীরতর লাভ হল, সে সব বুঝেছি / শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে”।

লেখক অধ্যাপক, রাজনীতি, সমাজ ও পরিবেশ বিশ্লেষক