শংকর ভারতী
১. হিঙ্গুলা বা হিংলাজঃ
সেই সাদাকালো বাংলা সিনেমার মরুতীর্থ হিংলাজ। পুরাণ অনুযায়ী এখানে সতীর মন বা মস্তিষ্ক পড়েছিল। পাকিস্তানের করাচি থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে এখানে দেবী দুর্গার নাম কোটারি। ভয়ঙ্কর তৃতীয় নয়নের জন্য শিব এখানে ভীমলোচন।
২. করবীপুরঃ
এই হিন্দুতীর্থও পাকিস্তানে। পাকিস্তানের কাছে এখানে সতীর তিনটি নয়ন পড়েছিল। দেবী এখানে মহিষমর্দিনী রূপে। এবং শিব আছেন ক্রোধীশ নামে।
৩. জ্বালামুখীঃ
কাংড়ার জ্বালামুখীতে সতীর জিভ পড়েছিল। হিমাচল প্রদেশের পাঠানকোটে এই তীর্থক্ষেত্রে দুর্গার নাম অম্বিকা। শিব আছেন উন্মত্ত রূপে।
৪.সুগন্ধাঃ
সতীর নাসিকা পড়েছিল। তাই নাম সুগন্ধা। বাংলাদেশের বরিশালের ঝালকাঠিতে আছে এই তীর্থক্ষেত্র। এই শক্তিধামে দেবীর দুর্গরা নাম সুনন্দা। মহাদেব এখানে ত্র্যম্বক।
৫. ভৈরব পাহাড়, অবন্তীঃ
সতীর ওষ্ঠ পড়েছিল এই পাহাড়ে। মধ্যপ্রদেশের অবন্তীর এই তীর্থে দেবী দুর্গা পরিচিত অবন্তী নামেই। আর শিব লম্বকর্ণ।
৬. অট্টহাসঃ
বীরভূমের এই শক্তিপীঠে সতীর অধর বা নিচের ঠোঁট পড়েছিল। দুর্গা এখানে ফুল্লরা নামে পূজিত। শিবের পরিচয় ভৈরববিশেষ্য বলে।
৭. প্রভাসঃ
মুম্বইয়ের কাছে এই জায়গাও একটি শক্তিপীঠ। এখানে সতীর পাকস্থলি পড়েছিল। দেবী দুর্গার নাম এখানে চন্দ্রভাগা। শিবের মূর্তি পূজিত বক্রতুণ্ড নামে।
৮. ইয়ানাস্থানাঃ
এই শক্তিপীঠে সতীর চিবুক পড়েছিল। বর্তমান করাচির কাছে পুণ্যভূমিতে দেবীর নাম ভ্রমরী এবং চিবুকা। শিবের নাম বিক্রকটাক্ষ এবং সর্বসিদ্ধিশ।
৯. গোদাবরীঃ
গোদাবরীর তীরে সতীর বাম গাল বা কপোল পড়েছিল বলে পৌরাণিক বিশ্বাস। দেবীর নাম এখানে বিশ্বমাতৃকা। মহাদেব পূজ্য দণ্ডপানি রূপে।
১০. গণ্ডকীঃ
সতীর ডান গাল বা কপোল পড়েছিল এই স্থানে। বিখ্যাত এই তীর্থক্ষেত্রে সতীর নাম গণ্ডকীচণ্ডী। আর শিবের পরিচয় চক্রপাণি।
১১.সূচিদেশঃ
বহুল পরিচিত দন্তেওয়াড়া নামে। মাওবাদী সন্ত্রাসের তকমা লেগে গেলেও ছত্তিসগড়ের জগদলপুরে এই জায়গা আসলে শক্তি পীঠ। পুরাণ বলে, এখানে ছিটকে এসে পড়েছিল দেবীর উপরের পাটির দাঁত। দেবী এখানে নারায়ণী। মহাদেব পূজিত হন সংহার রূপে। পঞ্চসাগরে পড়েছিল সতীর নীচের পাটির দাঁত। সতী এখানে বরাহী এবং শিব মহারুদ্র। দু জায়গাতেই দেবীর আর এক নাম দন্তেশ্বরী। তবে পঞ্চসাগরের অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কোনও কোনও মত বলে, হরিদ্বারের কোনও এক যায়গায় রয়েছে এই পুণ্যভূমি।
১২. ভবানীপুরঃ
এই সতীপীঠ এখন বাংলাদেশে। রাজশাহীর করতোয়া নদীর তীরে এই স্থানে দেবীর বাঁ নিতম্ব এবং পোশাক পড়েছিল। দুর্গা এখানে পূজ্য অপর্ণা নামে। শিবের পরিচয় ভৈরব। কথিত, নাটোরের রাজা এই মন্দিরে ধ্যান করতেন। প্রতি বছর রামনবমী উপলক্ষে এখানে বড় মেলা বসে।
১৩. শ্রী পর্বতঃ
দেবীর ডান নিতম্ব ছিটকে এসে পড়েছিল এখানে। দেবীর নাম এখানে সুন্দরী। শিবের নাম সুন্দরানন্দ।
১৪. কর্ণাটঃ
পুরাণ বলে, নারায়ণের সুদর্শন চক্রের ঘায়ে সতীর দুই কান এসে পড়ে এখানে। সেখান থেকেই নাম কর্ণাট। শিব পূজিত হন অভিরুক নামে। মনে করা হয় কর্ণাট নাম থেকেই কর্ণাটক নামের উৎপত্তি। বর্তমানে এই তীর্থক্ষেত্রটি মাইসোরে চামুণ্ডি পাহাড়ের উপরে।
১৫. বৃন্দাবনঃ
বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র হলেও এর আর এক পরিচয় শক্তি পীঠ বলে। সতীর কেশরাশি পড়েছিল এখানে। দেবী এখানে উমা। শিব পূজ্য ভূতেশ নামে।
১৬. কিরীটেশ্বরীঃ
মুকুট-সহ দেবীর শিরোভূষণ পড়েছিল এখানে। বর্তমান অবস্থান মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে। মূল মদির ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ নতুন করে মন্দির নির্মাণ করেন। দেবীর পরিচয় এখানে কিরীটেশ্বরী বা মুকুটেশ্বরী নামে। শিব পূজিত হন সংবর্ত রূপে।
১৭. শ্রীহট্টঃ
এই নামই এখন সিলেট। সুরমা নদীর তীরে বাংলাদেশের অন্যতম জেলা। এখানেই পড়েছিল সতীর ঘাড়ের একাংশ। দুর্গার নাম এখানে মহালক্ষ্মী, শিব সর্বানন্দ, শিবরাত্রি এবং অশোক-অষ্টমী উপলক্ষে প্রতিবছর মেলা হয়।
১৮. নলহাটিঃ
বীরভূমের এই স্থানও শক্তিপীঠ। কথিত, সতীর কণ্ঠনালী পড়েছিল এখানে। দেবী দুর্গা এখানে কালিকা এবং শিব হলেন যোগেশ।
১৯. কাশ্মীরঃ
সতীর ঘাড়ের আর এক অংশ পড়েছিল এখানে। দেবীর নাম এখানে মহামায়া এবং ত্রিসন্ধ্যাস্ভর। আরও সোজা ভাষায় বললে, তীর্থের নাম অমরনাথ। এই শৈব তীর্থ আসলে একটি শক্তিপীঠও বটে।
২০. রত্নাবলীঃ
এই শক্তিপীঠের অবস্থান নিয়ে রয়েছে দ্বন্দ্ব। কোনও কোনও মতে, এই তীর্থক্ষেত্র তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ে। কোনও কোনও মতে এই তীর্থক্ষেত্র বাংলার হুগলিতে। রত্নাকর নদীর তীরে | দেবী দুর্গা এখানে কুমারী এবং শিব হলেন ভৈরব।
২১. মিথিলাঃ
সতীর বাঁ কাঁধ ছিটকে এসে পড়ে এখানে। দেবী এখানে মহাদেবী এবং শিব পূজিত হন মহোদর রূপে। বর্তমানে জনকপুর স্টেশনের কাছে এই তীর্থস্থান।
২২. চট্টগ্রামঃ
কথিত, সতীর ডান হাত পড়েছিল এখানে। দেবী এখানে ভবানী এবং শিব এখানে চন্দ্রশেখর। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, কলি যুগে সীতাকুণ্ডের কাছে এখানে চন্দ্রশেখর পাহাড়ে নিয়মিত আসেন মহাদেব।
২৩.মানবক্ষেত্রঃ
বলা হয়, সতীর ডান হাত বা হাতের তালু পড়েছিল এখানে। গুসকরা স্টেশনের কাছে কোগ্রামের এই পুণ্যভূমিতে সতীর পরিচয় দাক্ষ্যায়ণী। শিব পরিচিত সিদ্ধিদায়ক রূপে।
২৪. উজ্জয়িনীঃ
মধ্যপ্রদেশের এই স্থানে পড়েছিল দেবীর কনুই। তিনি পূজিত হন মঙ্গলচণ্ডী এবং শিব পূজিত হন কপিলাম্বর রূপে।
২৫. পুষ্করঃ
দেবীর হাতের তালু থেকে কনুই অবধি অর্থাৎ মণিবন্ধ পড়েছিল এখানে। সতী এখানে পূজিত হন গায়ত্রী নামে। শিবের নাম সর্বানন্দ।
২৬. প্রয়াগঃ
ইলাহাবাদের ত্রিবেণী তীর্থে পড়েছিল সতীর হাতের দশ আঙুল। দেবীর নাম এখানে ললিতা এবং শিব হলেন ভবা।
২৭. বহুলাঃ
বর্ধমানের কেতুগ্রামের কাছে বহুলায় দেবীর বাঁ হাত পড়েছিল বলে বিশ্বাস। দুর্গার নাম এখানে বহুলা। শিবের পরিচয় ভীরুক নামে।
২৮. জলন্ধরঃ
পাঞ্জাবের এই অঞ্চলে পড়েছিল সতীর ডান স্তন। দেবী এখানে পূজিত হন ত্রিপুরমালিনী। শিবের রূপ ভীষণ।
২৯. রামগিরিঃ
ছত্তিসগড়ে বিলাসপুর স্টেশনের কাছেই এই তীর্থক্ষেত্র। বলা হয়, দেবীর বাঁ স্তন পড়েছিল এখানে। সতীর পরিচয় এখানে শিবানী এবং শিবের পরিচয় চণ্ড হিসেবে।
৩০. বৈদ্যনাথঃ
জশিডির কাছেই বিখ্যাত এই শৈব তীর্থক্ষেত্র আবার সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম। বিশ্বাস, এখানেই পড়েছিল সতীর হৃদয়। দেবীর নাম এখানে ‘জয়দুর্গা’। শিব হলেন বৈদ্যনাথ।
৩১. উৎকলঃ
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের কাছেই এই শক্তি পীঠ। কথিত, এখানে পড়েছিল সতীর নাভিদেশ। দেবীর নাম এখানে বিমলা এবং শিব পূজিত হন জগন্নাথ রূপেই।
৩২. বোলপুরঃ
কোপাই নদীর তীর নাকি পড়েছিল সতীর কঙ্কাল। তিনি এখানে দেবগর্ভ। শিবের নাম রুরু।
৩৩. কালমাধবঃ
অসমের শক্তি পীঠ। এখানে পড়েছিল সতীর ডান দিকের নিতম্ব। দুর্গা এখানে কালী। শিব পূজিত হন অসিতানন্দ রূপে।
৩৪.শোণঃ
মধ্যপ্রদেশের শোণ নদীর তীরে পড়েছিল সতীর বাঁ দিকের নিতম্ব। দেবী এখানে পূজিত হন নর্মদা এবং শিব পূজিত হন ভদ্রসেন পরিচয়ে।
৩৫. কামাখ্যাঃ
অসমের গুয়াহাটিতে ব্রহ্ম পুত্র নদীর তীরে নীলাচল পাহাড়ের উপরে দেবী কামাখ্যার মন্দির। পুরাণ বলে, এখানে দেবীর যোনি পড়েছিল। দেবীর নামও এখানে কামাখ্যা। জাগ্রত এই মন্দিরের কাছেই ব্রহ্ম পুত্রের চরে আছে উমানন্দ মন্দির। শিবের নাম এখানে উমানন্দ।
৩৬. নেপালঃ
দেবীর দুই হাঁটু পড়ে এখানে। দেবী এখানে মহশিরা। শিব হলেন কাপালি।
৩৭. শ্রীহট্টঃ
সেকালের শ্রীহট্ট বা একালের সিলেট। এখানে একাধিক শক্তি পীঠ আছে। দেবীর ঘাড়ের পাশাপাশি পড়েছিল বাঁ থাই। দেবী এখানে জয়ন্তী এবং শিব কর্মধীশ্বর।
৩৮. পাটনাঃ
এখানে নাকি পড়েছিল সতীর ডানদিকের থাই। দেবী এখানে সর্বনন্দোদরী। শিব হলেন ব্যোমকেশ।
৩৯. ত্রিপুরাঃ
সতীর নাম এখানে ত্রিপুরাসুন্দরী। শিব হলেন ত্রিপুরেশ্বর। প্রচলিত বিশ্বাস, দেবীর ডান দিকের পায়ের পাতা পড়েছিল এখানে।
৪০. ক্ষীরগ্রামঃ
বর্ধমানের এই গ্রামে পড়েছিল সতীর আঙুল-সহ ডান পায়ের পাতা। সতী এখানে যোগদায়া। শিবের নাম ক্ষীরকান্ত।
৪১. কালীঘাটঃ
কলকাতার ল্যান্ডমার্কগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মন্দির। প্রচলিত বিশ্বাস, এখানে ছিটকে পড়েছিল সতীর ডান পায়ের পাতা। শিব এখানে নকুলিশ বা নকুলেশ্বর।
৪২. কুরুক্ষেত্রঃ
কুরু-পাণ্ডবদের রণাঙ্গন আবার শক্তি পীঠও বটে। এখানে পড়েছিল সতীর ডান পায়ের গোড়ালি। তাঁর নাম এখানে সাবিত্রী বা স্থানু। শিব এখানে অশ্বনাথ।
৪৩ . বক্রেশ্বরঃ
বাংলার আর এক বিখ্যাত শক্তিপীঠ। বীরভূম জেলার এই তীর্থক্ষেত্রে পড়েছিল সতীর দুই ভ্রূয়ের মধ্যবর্তী অংশ। সতী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিত হন। শিব হলেন বক্রনাথ। বলা হয়, ঋষি অষ্টাবক্র এখানে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
৪৪: যশোরঃ
সতী এখানে যশোরেশ্বরী। শিব এখানে চন্দ্রধর। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী সতীর দু হাতের কিছু অংশ পড়েছিল এখানে।
৪৫. নন্দীপুরঃ
কোনও এক সময়ের নন্দীপুর গ্রাম মিলিয়ে গেছে কালের গর্ভে। এখন দেবী নন্দিনী অধিষ্ঠিতা সাঁইথিয়া শহরে। বিশ্বাস করা হয়, সতীর কণ্ঠহার পড়েছিল এখানে। শিব এখানে পূজিত হন নন্দীকিশোর রূপে।
৪৬. বারাণসীঃ
পুরাণে কথিত, মহাপ্রলয়ের পরেও অস্তিত্ব টিকে থাকবে এই প্রাচীন শহরের। বাবা বিশ্বনাথের জন্য বিখ্যাত হলেও কাশীধাম একটি শক্তি পীঠ। মনে করা হয়, সতীর কর্ণ কুণ্ডল বা কানের দুল পড়েছিল এখানে। তিনি এখানে বিশ্বলক্ষ্মী। মহাদেব এখানে কাল।
৪৭. কন্যাকুমারীঃ
দক্ষিণ ভারতে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এবং বঙ্গোপোসাগরের ত্রিবেণী সঙ্গমে দাঁড়িয়ে আছেন কন্যা দেবী। তিনি কুমারী। ভগবতী বা ভদ্রকালী হিসেবেও তিনি পূজিতা। শিব এখানে নিমিষা।
৪৮ . জাফনাঃ
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাফনার আর এক পরিচয় সতীপীঠ রূপে। পৌরাণিক মত অনুযায়ী, প্রাচীন সিংহলের এই অঞ্চলে পড়েছিল সতীর পায়ের মল। সতী এখানে ইন্দ্রাক্ষ্মী। শিব হলেন রক্ষশেশ্বর। পৌরাণিক মত অনুযায়ী ইন্দ্রাক্ষ্মীর মূর্তি বানিয়ে পুজো করতেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র।
৪৯ . বৈরাটঃ
রাজস্থানের জয়পুরের কাছে বৈরাট। সতী এখানে অম্বিকা। শিব হলেন অমৃত। পৌরাণিক বিশ্বাস মতে এখানে দেবীর পায়ের কিছু অংশ পড়েছিল।
৫০. বিভাসঃ
বঙ্গদেশের আর এক সতীপীঠ। পূর্ব মেদিনীপুরের কাছে তমলুকের এই তীর্থক্ষেত্রে পড়েছিল দেবীর বাঁ পায়ের গোড়ালি। সতী এখানে ভীমরূপা। শিব হলেন সর্বানন্দ।
৫১. ত্রিসোতাঃ
জলপাইগুড়িতে তিস্তার তীরে শালবাড়ি গ্রামে পড়েছিল সতীর বাঁ পায়ের পাতা। তিনি এখানে ভ্রামরী। শিব পূজিত হন ঈশ্বর রূপে। সতীর ৫১ পীঠ নিয়ে আছে বহু মত, দ্বিমত। কথা, উপকথা অনুসারে যুগে যুগে পল্লবিত হয়েছে বিশ্বাস। এবং সেই সনাতনী বিশ্বাসেই মিলিয়ে গেছে বস্তু। না’ই বা হল তর্কের দূরত্ব মেপে দেখা।