সেই ছোট্টবেলায় কলকাতা আকাশবাণীর ‘গল্পদাদুর আসর’-এ প্রথম গান গেয়েছিলেন। সে গানটির গীতিকার ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য। গান গেয়ে সেদিন ১২ বছরের মেয়েটি পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক হাতে পেয়েছিলেন। এতে গান গাইবার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। বয়স ১৪ হওয়ার আগেই মেয়েটির প্রথম বেসিক রেকর্ড বেরলো এইচএমভি থেকে। এক পিঠে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে’, উল্টো পিঠে ‘তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো।’ গিরিন চক্রবর্তীর কথা ও সুরে সেই রেকর্ড-এর গান শুনে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল সারা বাংলার শ্রোতারা।
এর বছর দুয়েক পরেই সিনেমার গানে তাঁর কাছে ডাক এসে গেল। নিউ থিয়েটার্স তখনকার সময়ে এক নম্বর ব্যানার। সিনেমায় গান রেকর্ড করলেন সুরকার রাইচাঁদ বড়ালের সুরে ‘অঞ্জনগড়’ এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘সমাপিকা’ ছবির জন্য।ওই একই বছরে আরও তিনটি আধুনিক গান রেকর্ড করে সঙ্গীত জগতে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ভজন বিভাগে সন্ধ্যা প্রথম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সেই প্রতিযোগিতায় ছিলেন মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এরপর ‘ভজন’ ও ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষাতেই প্রথম হন। দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম হওয়ার পর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গান গাওয়া। একাধারে খেয়াল, ঠুংরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, পুরাতনী— বাংলা গানের সমস্ত ধারাতে সন্ধ্যা তাঁর মুন্সিয়ানারসাক্ষর রেখেছিলেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তালিম।গান শিখেছেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি, চিন্ময় লাহিড়ী, এ কানন, ডিটি যোগী, গণপত রাও, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, এবং সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে।
বলাই বাহুল্য যে তাঁর সঙ্গীত শিক্ষার দিকটি ছিল মূলত পটিয়ালা ঘরানায় দীক্ষিত। তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমন গভীর তালিম নিয়েও বাংলা আধুনিক, সিনেমার গান কিংবা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সময় সন্ধ্যা অনায়াসেই তাঁর শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী সত্ত্বাটি লুকিয়ে রাখতেন। যে গানের যে শৈলী, সেই গান সেই শৈলীতেই তাঁর গাওয়ায় প্রাণ পেত।
বিগত শতকের চারের দশকপ্রায় শেষ দিকের কথা। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘বিদুষী ভার্যা’ ছবির গান রেকর্ডিং করে সন্ধ্যাসবে মাত্র বাড়ি ফিরেছেন।শচীন গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজন তিনি শচীন দেববর্মনের পরিচিত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে এসে বললেন, ‘শচীনকত্তা আপনাকে বম্বে নিয়ে যেতে চান। কত্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মনও আপনার গানের কথা শুনেছেন, তিনিও আপনার গান শুনতে চেয়েছেন।’ শচীনদেব বর্মন তার আগে মুম্বাই চলে গিয়েছেন। তখনও মীরাদেবী কলকাতায় সাউথ অ্যান্ড পার্কের বাড়িতে থাকতেন। এর পর একদিন সন্ধ্যা মীরাদেবীকে তাঁর বাড়িতে গিয়ে গান শুনিয়ে এলেন। শুনে যে ভাল লেগেছিল তা বলাই নিষ্প্রয়োজন। এরপরেই সন্ধ্যা মুম্বাই যাত্রা করলেন।

মুম্বাইয়ে শচীনদেবের আস্তানা ছিলখার স্টেশনের পাশে ‘এভারগ্রিন’ হোটেলে। সন্ধ্যার জন্য তিনি সেখানেই থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন।সন্ধ্যাএর আগে থেকে শচীনদেব বর্মনকেচিনতেন। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে তাঁদের আলাপ হয়েছিল। সন্ধ্যাকে কত্তা মুম্বাই নিয়ে গেলেও সেখানে তাঁর প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ ঘটে ‘তারানা’ ছবিতে, অনিল বিশ্বাসের সুরে।সন্ধ্যার বড়দাও নাকি মুম্বইয়ে অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। মাঝে মাঝেই সন্ধ্যাঅনিল বিশ্বাসের বাড়িতে যাতায়াত করতেন, গানবাজনা হত। ‘তারানা’ ছবিতে গাইতে গিয়েই সন্ধ্যার সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয় হয়। ছবির গানটিও ছিল লতার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে— ‘বোল পাপিহে বোল রে, তু বোল পাপিহে বোল’। অভিনেত্রী মধুবালার লিপে লতার কণ্ঠ আর সন্ধ্যার গান ছিল শ্যামার লিপে। অনিল বিশ্বাসের সুরে সন্ধ্যাপরে ‘ফরেব’ ছবিতেও গেয়েছেন। সেই পরিচয়ের কিছু দিনের মধ্যেই লতার সঙ্গে সন্ধ্যারঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। এভারগ্রিন হোটেলে সন্ধ্যার কাছে লতা প্রায়ই আসতেন। সাধারণ বেশভূষা, আন্তরিক ব্যবহার। লতাকে ভাল লেগেছিল সন্ধ্যার। লতার সঙ্গে গান নিয়ে নানা আলোচনা হত। পরবর্তী কালে সন্ধ্যার ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও এসেছেন লতা।
সন্ধ্যা সতেরোটি হিন্দি ছবিতে গান করেছেন। তবে বলিউডে নিজের সঙ্গীত জীবন তিনি লম্বা করেননি। কয়েক বছর পরেই তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিয়ের পর সন্ধ্যার জীবন অনেকটা বদলে যায়। বাইরের জগতের অনেক কিছু যাতে তাঁকে স্পর্শ না করে, যাতে তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেন, তাঁর স্বামী সবসময় সেই চেষ্টাই করেছেন। এই সময় সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে একের পর এক আধুনিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে চুটিয়ে বাংলা ছবির গান। শিল্পী জীবনের অন্যতম মাইলফলক ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ও এই সময়।


সুচিত্রার লিপে প্রথম সন্ধ্যার কণ্ঠ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে। প্রথম থেকেই সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটি সুপারহিট! সুচিত্রা এমন ভাবে লিপ দিয়েছিলেন, যে দর্শকদের মনে হয়েছিল যেন তিনি নিজেই গাইছেন। সন্ধ্যার উচ্চারণ, অভিব্যক্তি— সব মিলিয়ে বাংলা ছবির গান অন্য মাত্রা পেতে থাকে। বাংলা গানে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের প্রচলন করেছিলেন। অন্যদিকে সুচিত্রা মানেই যেন সন্ধ্যা। বিভিন্ন ধারার গানে অনায়াস বিচরণ ছিল সন্ধ্যার। এটি তাঁর সঙ্গীত জীবনের স্বতন্ত্র একটি আসন।
3 Comments
লেখাটি থেকে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেল।
একথা তো ঠিকই; নিজেকে আপাদমস্তক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানায় তৈরি করে তিনি বাংলা আধুনিক ও সিনেমার গানই বেশি গেয়েছেন, তবে তা গাইতে গিয়ে নিজের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের
জ্ঞানকে সেই গানে চাপিয়ে না দিয়ে তা সরিয়ে রেখেছেন, এটা সবাই পারেন না।
কত গান যে গেয়েছিলেন তিনি হিসাব রাখবে পরিসংখ্যান যারা করেন তাঁরা, শ্রোতাদের স্মৃতিতে থাকবে তার নিজস্ব পছন্দের গান, সেই গানেই তিনি বেঁচে থাকবেন যতদিন গান থাকবে সুর থাকবে আর থাকবে সুন্দর পৃথিবী।